খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি নিরাপত্তা জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম অনুসঙ্গ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী শক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভ’রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়ে থাকে। পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় জ্বালানি শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রধান অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত আমদানি নির্ভর দেশ বিশ্বের পেট্টোলিয়াম উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কৌশল জারি রেখেছে। ওআইসির সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলো থেকে বিশেষ সুবিধায় জ্বালানি আমদানির সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। সে সব সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশে নতুন তেল শোধনাগার স্থাপনসহ জ্বালানি নিরাপত্তায় স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার সুযোগ থাকলেও আদতে তা কাজে লাগানো হয়নি। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের মত ভারতও জ্বালানিখাতে আমদানিনির্ভর হয়েও বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। পেট্টোলিয়াম আমদানির জন্য ভারতের সাথে মৈত্রী পাইপলাইন স্থাপন এবং বিদ্যুৎখাতে ভারতীয় সরকারি-বেসরকারি কোম্পানির উপর নির্ভরতা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বড় ধরণের হুমকি ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ, তেল ও এলএনজি আমদানি এবং অফশোর গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতীয় কোম্পানির উপর নির্ভরতার ঝুঁকি অগ্রাহ্য করা কোনো সুযোগ নেই।
চলতি অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রীডে বিপর্যয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০টি জেলা অন্তত ৮ ঘন্টা ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে জাতীয় বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে নজিরবিহিন বিপর্যয়ে সারাদেশে ব্ল্যাক-আউটের কবলে পড়েছিল। বিদ্যুত গ্রিডের সে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে যে বিষয়টি আলোচনায় সামনে এসেছিল, তা হচ্ছে, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি। তখন ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানির নানামুখী ঝুঁকির বিষয়গুলোও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু গত এক দশকে বিদ্যুতসহ জ্বালানি খাতে ভারত নির্ভরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। দেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়ে যে সব দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে, ভারতীয় কোম্পানিগুলোর আমাদের আমলাতান্ত্রিক যোগসুত্র তার নেপথ্যে ভ’মিকা রাখছে বলে সহজেই অনুমেয়। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে মাতারবাড়ী-মদনাঘাট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও টাওয়ার নির্মানে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেইসি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পুকুর চুরির তথ্য বেরিয়ে আসে। জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৯২ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের এই প্রকল্প বাস্তায়নে কিভাবে এই প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছিল তার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাতারবাড়ীর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ৪শ কিলোভোল্টের টাওয়ার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বড় ধরণের ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। বিশেষত এ ধরণের টাওয়ার নির্মানে যে ধরণের পাইলিং ও গভীরতা থাকার কথা তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রকল্পের ৯৭৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে ভারতীয় কোম্পানিটি।
খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরতার কারণে আমাদেরকে বার বার তিক্ত অভিজ্ঞতা ও মূল্যস্ফীতির চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। জরুরি সময়ে বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে অনাকাঙ্খিত শর্ত জুড়ে দিয়ে বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতেও দেখা গেছে। এখন জ্বালানি খাতে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে জিম্মিদশায় পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুত গ্রিডে বিপর্যয় কিংবা ভারতীয় কোম্পানির টাওয়ার নির্মানে বিপজ্জনক ফাঁকিবাজি ও মানহীনতা শুধু যে জনগণের ট্যাক্সের টাকার বেপরোয়া অপচয় তাই নয়, এ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ ও মানহীন টাওয়ার যে কোনো প্রাকৃতিক দুযোর্গে ভেঙ্গে পড়লে তা দেশের জন্য বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। পিআইটি কিউব টেস্টের ভূয়া রিপোর্টের অভিযোগও উঠেছে। এ ক্ষেত্রে মূল প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ(পিজিসিবি)এর সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। টাওয়ার নির্মাণে অনিয়মসহ পিজিসিবি’র দুর্নীতি তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের অস্বচ্ছতা ও লুকোচুরির বিষয়টাও উঠে আসছে। পাওয়ার গ্রিডের মান নিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে গোপন আপস বা দুর্ণীতি হয়ে থাকলে স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে তা বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ ধরণের সঞ্চালন লাইনের টাওয়ারের মান ও গভীরতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তা সঠিক মানে উন্নীত করতে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মত স্পর্শকাতর ও খাতে ভারতের উপর নির্ভরশীলতা পরিহার করতে হবে। বিদ্যুত ও জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ও টেকসই সরবরাহ ব্যবস্থা এবং নিজস্ব পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বিদ্যুত ও জ্বালানি অত্যন্ত স্পর্শকাতর খাত হওয়ায় বিদেশী কোনো কোম্পানির হাতে সঞ্চালন লাইন ও টাওয়ার নির্মাণের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হলে তা নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির ক্ষমতা দেশের পিজিসিবি’র হাতে থাকতে হবে। ভারতীয় কোম্পানির নির্মিত টাওয়ার ও সঞ্চালন লাইনের কাজ কেমন হয়েছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে পিজিসিবি ও দুদকের ভ’মিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা আশা করবো, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি ও পুকুরচুরির অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পিজিসিবি এবং দুদকের সংশ্লিষ্টরাও এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন