বিরোধীদল বিএনপি তার রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে দশ সাংগঠনিক বিভাগে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত দশটি গণসমাবেশের ঘোষণা দেয়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় গণসমাবেশ হয়েছে। আজ রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ ময়দানে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সমাবেশ বানচাল বা এতে যাতে লোকজন বিভিন্ন এলাকা থেকে যোগ দিতে না পারে, এজন্য সরকারের ইন্ধনে পরিবহন মালিক সমিতি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই ধর্মঘট চলবে। আগের সমাবেশগুলোতেও অনুরূপ বাধা সৃষ্টি করা হযেছে। আগামী ৫ নভেম্বর বরিশালে গণসমাবেশের দিনও ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যেদিনই বিএনপি’র গণসমাবেশ থাকে, সেদিনসহ আগের দিন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। আবার সমাবেশ শেষ হলেই আপনা-আপনি ধর্মঘটও উঠে যায়। তাদের এ কূটকৌশলের আসল মোজেজা সাধারণ মানুষও বোঝে। বিএনপি’র গণসমাবেশ ঠেকাতেই যে তাদের এই উদ্দেশ্যমূলক ধর্মঘট, তা বুঝতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধর্মঘট নিয়ে বলা হয়, পরিবহন মালিক সমিতি যদি তাদের যানবাহন ক্ষতির আশঙ্কা থেকে ধর্মঘটের ডাক দেয়, তাতে তাদের কি করার আছে? এটা যে নিছকই একটা কথার কথা, তা না বোঝার কিছু নেই।
বিএনপি’র বিগত তিনটি বিভাগীয় গণসমাবেশের দিন ধর্মঘট ডেকেও সেগুলো বন্ধ করা যায়নি। দলটি ঠিকই শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করেছে এবং গণপরিবহন সংকট ও পথে পথে বাধা সত্ত্বেও বিপুল মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছে। ধর্মঘট না থাকলে হয়ত, আরও অনেক বেশি সমাগম হতো। দেখা গেছে, প্রতিটি গণসমাবেশে দলটির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে, টেম্পু, মিনি ট্রাক কিংবা অন্যকোনো উপায়ে সমাবেশস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা চিড়া-মুড়ি ও শুকনো খাবার নিয়ে সেখানে এবং শহরের ফুটপাতে পর্যন্ত রাত কাটিয়েছে। সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য এ ধরনের চিত্র সাম্প্রতিককালে বিরল। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাবেশ ঠেকানোর জন্য সরকার কেন এ ধরনের আচরণ করবে? এটা করেও কি সমাবেশে লোকজনের উপস্থিতি ঠেকাতে পারছে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিরোধীদলের সভা-সমাবেশ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে, এমনকি এই উপমহাদেশেও বিরোধীদলের সভা-সমাবেশ নির্বিঘ্ন করতে সরকার সহযোগিতা করে। বিরোধী দল কি বলতে চায়, তা সরকার শুনতে চায়। অথচ আমাদের দেশেই ঘটছে উল্টো ঘটনা। সরকার একদিকে নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করছে, অন্যদিকে বিরোধীদলের সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ঠেকানোর অপপন্থা অবলম্বন করছে। এতে কি সরকারের লাভ হচ্ছে? হচ্ছে না। বরং পর্যবেক্ষকরা এ ধরনের আচরণকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আচরণ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বাংলাদেশের বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে গণতন্ত্রের সংকটের কথা উন্নত বিশ্ব এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। ‘হাইব্রিড’, ‘অথরটিয়ান’ ইত্যাদি নানা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা সরকারকে গণতন্ত্রের উন্নয়ন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বারবার তাকিদ দিয়ে আসছে। বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বারবার তার বক্তব্য-বিবৃতিতে এ কথা বলছেন। দাতা সংস্থা আইএমএফ-এর প্রতিনিধি দলও এখন বাংলাদেশ সফর করছে। তারাও এদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা স্বচক্ষে দেখছেন। উল্লেখ্য, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। গত বুধবার ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি এবং আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মার্কিন নিরাপত্তা কাউন্সিলের কৌশলগত যোগযোগ সমন্বয়ক জন কিরবি একাধিকবার বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিরোধী-ভিন্নমতকে হয়রানি বন্ধ তথা ভীতিমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। অন্যান্য দাতা দেশ ও সংস্থা একই কথা বলছে। সরকার এসব সতর্ক বার্তা ও কথা আমলে নিচ্ছে বলে মনে হয় না। উল্টো বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঠেকানোর নানা অপকৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে। বিরোধীদলের সভা-সমাবেশ নির্বিঘ্নে করতে দেয়ার মানে এই নয়, সরকারের পতন হয়ে যাবে। তাহলে, এসব সভা-সমাবেশ নিয়ে সরকারের কেন এত ভীতি? সরকারের এ আচরণ এমন সময়ে প্রতিফলিত হচ্ছে, যখন দেশ অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিৎ এদিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। বাংলাদেশের একটি ভালো ইমেজ তুলে ধরে বৈশ্বিক সহযোগিতা আদায় করা। তা না করে, করছে উল্টোটা।
বিএনপি’র গণসমাবেশে শুধু তাদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাই নয়, অসংখ্য সাধারণ মানুষও যোগ দিচ্ছে। এসব সমাবেশে বাধা দিয়ে সরকার নিজের ভাবমর্যাদাই বিনষ্ট করছে। এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত ও কাম্য নয়। সরকারের উচিৎ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও বিরোধী রাজনীতির অবাধ পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়ে নিজের ভাবমর্যাদা উন্নত করা। এর ব্যত্যয়ে দেশ ও বিদেশে সরকারের বদনাম হচ্ছে। বিরোধীদলের সভা-সমাবেশে ধর্মঘট ডেকে যারাই বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্ট করছে, তারা সরকারের উপকারের পরিবর্তে অপকার করছে। এতে বিরোধীদলের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ সরকারের ওপরই বর্তাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিরোধীদলের সভা-সমাবেশে কোনো বাধা দেয়া হবে না। তারপরও ধর্মঘটের নামে পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে যারা বিরোধীদলের সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করেছে এবং করছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর কথার খেলাপ করছে। আমরা মনে করি, বিরোধীদলের সমাবেশে বাধা দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়। এটি গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা এবং রাজনৈতিক সংঘাত উসকে দেয়ার শামিল। এ ধরনের আচরণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারের উচিত, দেশের অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে বিরোধীদলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের সংঘাতের সৃষ্টি না হয়, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা অবারিত করা। যেকোনো ধরনের বাধা ও উসকানি থেকে দূরে থাকা। বিরোধীদলেরও উচিত, সভা-সমাবেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন