শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অব্যাহত খুনের ঘটনায় বাড়ছে উদ্বেগ আতঙ্ক ৫ মাসে ২৫ মাঝি খুনসহ ১২৪ হত্যাকাণ্ড

কক্সবাজার ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০২২, ১১:২৯ এএম

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে প্রতিনিয়ত খুনখারাবীর ঘটনায় বাড়ছে উদ্বেগ আতঙ্ক।

এসব খুনাখুনির পেছনে মাদকের টাকা ভাগাভাগি, প্রত্যাবাসনের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান এবং একাধিক গ্রুপের প্রভাব বিস্তার বলে জানা গেছে। এতে শুধু চলতি মাসেই প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছে ৯ জন রোহিঙ্গা মাঝি। এভাবে গত ৫ মাসে খুন হয়েছে ২৫ জন। আর এপর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সর্বমোট খুন হয়েছে ১২৪ জন রোহিঙ্গা। এসব খুনের ঘটনায় চরম আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সাধারণ রোহিঙ্গারা।

নিহতদের স্বজন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়কারি অপরাধীদের ধরতে সহযোগিতা বা কোন মামলার স্বাক্ষী হলেই মুখোশধারীদের টার্গেট হয়ে এসব খুন সংঘটিত হচ্ছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) ভোরে দিকে কুতুপালং ১৭ নম্বার ক্যাম্পের সি ব্লকে ২ রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

এতে নিহতরা হলেন, কুতুপালং ১৭ নম্বার ক্যাম্পের সি ব্লকের কেফায়েত উল্লাহর পুত্র আয়াত উল্লাহ (২৬) ও মোহাম্মদ কাসিমের পুত্র ইয়াছিন (৩০)।

১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক সৈয়দ হারুনুর রশিদ জানিয়েছেন, ভোরে ১৫/২০ জনের একদল সন্ত্রাসী ১৭ নাম্বার ক্যাম্পের সি ব্লকে হামলা চালায় এসময় সন্ত্রাসীরা আয়াত উল্লাহ এবং ইয়াছিনকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এসে গুলি করে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ইয়াছিনের মৃত্যু হয় এবং আয়াত উল্লাহকে এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ঘট চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, খুনের কারণ এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ ঘটনায় একজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মৃতদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে আনা হলে কথা হয় নিহতের স্বজনদের সাথে। নিহত আয়াত উল্লাহ'র ভাই সালামত উল্লাহ জানান, তার ভাই ক্যাম্পে চাকরি করে। দুর্বৃত্তরা সবাই মুখোশধারী, কাউকে চেনা যায়নি। সবার হাতে অস্ত্র ছিল। দুর্বৃত্তরা তার ঘরের চারদিকে ঘিরে দরজা কেটে এবং বেঁড়া ভেঙ্গে রাত সাড়ে ৩ টার দিকে গুলি করে ভাইকে হত্যা করেছে।

তিনি জানান, তার ভাই অপরাধিদের নানা তৎপরতার বিরুদ্ধে কথা বলতো, বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতো। তাই এ হত্যা কান্ড ঘটানো হয়েছে।

নিহত মোহাম্মদ ইয়াছিনের ভাই মোহাম্মদ হাছন বলেন, “আয়াত উল্লাহর এক ভাইয়ের হাত ও পা কেটে ফেলেছিলো দুর্বৃত্তরা। তখন মাঝি ও পুলিশকে আমার ভাই সহযোগিতা করত। এজন্য দুর্বৃত্তরা টার্গেট করে আমার ভাই ইয়াছিনকে মেরে ফেলেছে। তারা ইয়াছিনকে মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কুপিয়েছে। তারা

আমাকেও ধরতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি অন্যদিকে পালিয়ে যাওয়ায় আমাকে ধরতে পারেনি। এখন যা হবার হয়ে গেছে, সামনে এ ধরণের ঘটনা যাতে না ঘটে এজন্য ক্যাম্পে র‍্যাব ও সেনা বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তার দেয়ার দাবি করছি।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২৪ টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৫ মাসে (২৭ অক্টোবরের ২ জনসহ) ২৫ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের বেশিভাগ ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক। যার মধ্যে শুধু মাত্র অক্টোবরে ৯ টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বুধবার (২৬ অক্টোবর) ক্যাম্প ১০ এ খুন হন মোহাম্মদ জসিম, একই দিন মো. সালাম নামের এক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হন। ১৮ অক্টোবর ক্যাম্প ১৯ এ খুন হন সৈয়দ হোসেন। সৈয়দ হোসেন এর পিতা জামাল হোসেন গত ১০ অক্টোবর খুন হয় । এ মামলার বাদি এবং আসামিদের ধরতে তৎপর থাকায় সৈয়দ হোসেনকে খুন করা হয় বলে জানিয়েছেন ৮ এপিবিএন এর সহকারি পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ।

১৫ অক্টোবর ক্যাম্প ১৩ এর মাঝি মোহাম্মদ আনোয়ার ও সাব মাঝি মোহাম্মদ ইউনুছকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১২ অক্টোবর হত্যা করা হয় ৯ এর সাব মাঝি মোহাম্মদ হোসেনকে। ৪ অক্টোবর এবিপিএনর সাথে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে নিহত হন তাসদিয়া আকতার (১১) নামের এক শিশু। এর আগে ৪ মাসে খুন হন ১৬ জন। এর মধ্যে ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ
এরশাদ (২২) নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)।

২১ সেপ্টেম্বর খুন হওয়া মোহাম্মদ জাফরের স্ত্রী খুরশিদা খাতুন জানান, তার স্বামী অপরাধিদের নানা অপতৎপরতার তথ্য প্রশাসনকে জানাতো। এর জের ধরে একবার হামলা চালিয়ে তার হাতে জখম করে। পরে তাকে হত্যা করেছে। এ হত্যার পেছনে একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ দায়ী বলে জানান তিনি। মোহাম্মদ জাফরের মা ছুরা খাতুন জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরাই তার ছেলেকে হত্যা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় জাফরকে খুন করা হয়।

এছাড়া ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যার। গত ২২ জুন কথিত একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে ২ স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, ১ জুন খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।

ক্যাম্প ১৭ এর বাসিন্দা মোহাম্মদ মুজিব বলেন, “ক্যাম্পে সুস্থ্যভাবে থাকতে চাইলেও থাকতে পারছি না। রোহিঙ্গাদের মধ্যেই একটি চক্র আমাদেরকে নির্যাতন করছে। আমরা পুলিশকে এসব বিষয় জানিয়েছি। এছাড়াও নানা ঘটনায় বাদি হয়েছি, স্বাক্ষী হয়েছে অনেকেই। এর জন্য দুর্বৃত্তরা আমাদেরকে মেরে ফেলছে।
আমরা এখন ক্যাম্পে নিরাপত্তা চাইছি, যাতে ভালো প্রশাসন দেয়া হয়।
৮ এপিবিএন এর সহকারি পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ জানিয়েছেন, ক্যাম্পে মাদক সহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিরোধ সহ নানা কারণে খুনের ঘটনা হয়। এর পাশাপাশি অপরাধিদের তথ্য প্রদান বা বাধা প্রদান করলে প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেও খুন সহ হামলার ঘটনা ঘটে।

মেম্বার হেলাল উদ্দিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পে খুনোখুনি, মারামারি, গোলাগুলি, মাদক, অপহরণ নানা অপরাধ বেড়েছে। এখন স্থানীয়রাও খুবই আতঙ্কের মধ্যে আছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের মাধ্যমে ক্যাম্পে যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার হচ্ছে তা উদ্ধার এবং অপরাধীদের যেন আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, ক্যাম্পে প্রতিটি খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এপিবিএন ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর রয়েছে। একই সঙ্গে মামলার তদন্তও চলছে।


এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে, শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) দিবাগত রাতে সমন্বিত অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এতে একাধিক অ্যাডিশনাল এসপি, এএসপি ও পুলিশ পরিদর্শক নিয়োজিত ছিলেন বলে জানান ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ ফারুক আহমদ।

এসময় ক্যাম্পের সম্ভাব্য স্থানে চিরুনি অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ড, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ৪১ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন