স্টাফ রিপোর্টার : মোবাইল ফোন অপারেটর রবি ও এয়ারটেলের ব্যবসা একীভূতকরণের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা। তবে গ্রাহকস্বার্থ ও বাজার প্রতিযোগিতা এবং কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা ও সুষ্ঠু তরঙ্গ ব্যবস্থাপনার ওপরও জোর দিয়েছেন তারা। রবি ও এয়ারটেলের একীভূতকরণ প্রস্তাবের ওপর গতকাল (বুধবার) টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সভা কক্ষে এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর সংশ্লিষ্ট ধারা ৮৭ অনুযায়ী গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট গণশুনানি কমিটির সভাপতি ও বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহ্জাহান মাহমুদ এতে সভাপতিত্ব করেন। গণশুনানির অন্য সদস্য কমিশনার (এসএম) এটিএম মনিরুল ইসলাম ও কমিশনার (এলএল) মোঃ জহিরুল ইসলামসহ কমিশনের অন্যান্য কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এতে উপস্থিত ছিলেন। গণশুনানিতে সাধারণ মোবাইল গ্রাহক/ভোক্তা, বিভিন্ন সরকারি/আধাসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, শিক্ষক-ছাত্র, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী, উন্নয়নকর্মী, আইনজীবী, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং রবি ও এয়াটেলসহ মোবাইল অপারেটরস/সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী শতাধিক নিবন্ধনকারী ব্যক্তি অংশ নেন।
শুরুতেই বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, গণশুনানিতে মোট ৯৮ জন নিবন্ধন করেন। লিখিতভাবে মতামত দেন ১০০ জন। তবে শুনানিতে উপস্থিত থেকে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন মাত্র ৩৪ জন। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত এ শুনানি চলে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষে ব্যারিস্টার আনিক আর হক বলেন, দুটি অপারেটর একীভূত হলে তাদের রবি’র তরঙ্গ (স্পেকট্রাম) সবচেয়ে বেশি হবে। একীভূত হওয়ার পর দুই অপারেটরের তরঙ্গও একীভূত হবে কিনা আইন অনুযায়ী তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, একীভূত হলে দুই কোম্পানির কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এক বছর পর আবার স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়ার কোনো স্কিম ঘোষণা করা হবে কি না তাও আগে থেকে জানানো উচিত। এ দুই কোম্পানি একীভূত হওয়ার পর বড় তিনটি অপারেটরের (গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি) মার্কেট শেয়ার হবে ৯৬ শতাংশ। বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে গেলে প্রতিযোগিতা থাকবে না। তখন গ্রাহক সেবা নিয়ে অপারেটরদের আর মনোযোগ নাও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আনিক আর হক। ব্যবসায়ী ফারহান চৌধুরীও একীভূত হওয়ার পর সেবা পাওয়ায় কোনো সমস্যা যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আহমেদ আল সামী শুনানিতে বলেন, রবি ও এয়ারটেল একীভূত হলে তারা ১০ কোটি করে মোট ২০ কোটি নম্বর জেনারেট করতে পারবে। এতে অন্য অপারেটরদের কোনো সমস্যা হবে কি-না তা দেখতে হবে। ব্যবসায়ী আশিক চৌধুরী বলেন, কোনো একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ না হয়ে একীভূত করার পর টিকে থাকা ভালো। তবে এয়ারটেলের নম্বরটা ঠিক রাখতে চাই।
রবির পিপল অ্যান্ড করপোরেট বিভাগের টেকনিক্যাল রেগুলেশনস বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অনামিকা ভক্ত বলেন, একীভূত হলে দুই বা তিন বছর নম্বর ঠিকই থাকবে। তবে একটি সময়ের পর আর এয়ারটেলের নম্বর নতুন করে দেওয়া হবে না। টেলিযোগাযোগ খাতের সার্ভিস প্রোভাইডার একটি কোম্পানির কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, একীভূতকরণের পর অযাচিত ট্যারিফ যাতে গ্রাহকের ওপর না পড়ে। আইনজীবী ফাতেমা আনোয়ার বলেন, গণশুনানিতে ৯৮ জন দেশের ১৭ কোটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। একীভূত হলেও গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আইনজীবী ইউসুফ আলী বলেন, একীভূত হওয়ার পর তিনটি অপারেটরের হাতে ৯৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার চলে গেলে নতুন বিনিয়োগ হবে না। এর ফলে গ্রাহকদের জন্য ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ইউসুফ আলী বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে এ বিষয়ে সমীক্ষা করা উচিত। যে দুটি সংস্থা এখন এ সমীক্ষা করছে, তাদেও কোনো অভিজ্ঞতা নেই। গত ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, রবি ও এয়ারটেলের সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা প্রায় চার কোটি। আর সাড়ে ৫ কোটির বেশি গ্রাহক ব্যবহার করেন গ্রামীণফোন।
একীভূত হওয়ার বিষয়টি চারটি বিষয়ের উপর নির্ভর করছে জানিয়ে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, মার্জারের (একীভূতকরণ) বিষয়ে কোনো গাইডলাইন না থাকায় চার স্তরে পদক্ষেপ গ্রহণ করে রবি Ñ এয়ারটেলের মার্জারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে বিটিআরসি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, চার স্তরের প্রথম স্তরে দু’জন প্রফেসরকে ইম্প্যাক্ট স্টাডি কারার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরে মার্জারের সাথে জড়িত নয়, এমন চারটি মোবাইলফোন অপারেটরের বক্তব্য শোনা হয়েছে, তৃতীয় স্তরে গণশুনানী করা হলো ও ই মেইলে মতামত নেয়া হচ্ছে এবং চতুর্থ স্তরে প্রাপ্ত সব মতামত পর্যালোচনা করে বিটিআরসি’র গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তাদের সুপারিশ করবে। এ চার স্তর থেকে বিটিআরসি কমিশন মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা ডাক ওটেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে জানাবে। আর একীভূত হলেও চাকরি যাবে না Ñ এই নিশ্চয়তা দুই অপারেটর থেকেই পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। যে দুটি সমীক্ষা করা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ীই করা হচ্ছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাজার প্রতিযোগিতার বিষয়টিও রয়েছে বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর রবি ও এয়ারটেল ব্যবসা পরিচালনা একীভূত করার জন্য কমিশনে আবেদন করে। ৩০ সেপ্টেম্বর কমিশনের ১৮৯তম সভায় কিছু শর্ত সাপেক্ষে একীভূত হওয়ার প্রস্তাবটি পূর্বানুমতি গ্রহণের জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শর্ত প্রতিপালনের জন্য প্রতিষ্ঠান দু’টিকে চিঠি দেয়। বাংলাদেশে এই ধরনের বড় দু’টি কোম্পানির একীভূত হওয়ার ঘটনা বিরল এবং দেশের মোবাইল ফোন খাতে প্রথম হওয়ায় কমিশন আর্থ-সামাজিক ও কারিগরি ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা কার্যক্রমটি অত্যন্ত জটিল ও সময় সাপেক্ষ বিধায় কমিশন হতে সমীক্ষা কার্যক্রমকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কারিগরি সংক্রান্ত সমীক্ষাসমূহ পরিচালনার দায়িত্ব আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর প্রফেসর ড. এবিএম সিদ্দিক হোসেন এবং কারিগরি বিষয়সমূহ ব্যতীত আর্থ-সামাজিক বিষয়সহ অন্যান্য সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের প্রফেসর ড. এস. এম মাহফুজুর রহমান এর নেতৃত্বে দুটি টিমকে। পরবর্তীতে গত ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগ রবি ও এয়ারটেল একীভূতকরণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমিশনের মতামত সম্বলিত প্রতিবেদন আগামী ৭ মার্চের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে প্রেরণের জন্য কমিশনকে নির্দেশনা প্রদান করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন