২০২৩-২৫ মেয়াদের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) পঞ্চমবারের মতো সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। নিয়ম অনুযায়ী, কাউন্সিলের সদস্যদেশগুলো ৩ বছরের মেয়াদে কাজ করে এবং পরপর দুই মেয়াদে সদস্য থাকার পরে অন্তত ১ বছর বাদ দিয়ে আবার নির্বাচন করতে পারে। বাংলাদেশ সর্বশেষ ২০১৯-২০২১ মেয়াদে মানবাধিকার কাউন্সিলে দায়িত্ব পালন করেছিল।
জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ১৯৪৫ সালে ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্য নির্বাচিত হওয়া নিয়ে পক্ষ -বিপক্ষে অনেক কথাই হচ্ছে। এসব কথার বেশিরভাগই আবার কুকথা। খÐিত বা মনগড়া কথা আরো বেশি। এ নিয়ে দল, সরকার, দেশ সব গুলিয়ে ফেলার একটি ধুমও চলছে। বুঝে বা না বুঝে এসব কথামালা স্যোশাল মিডিয়া ডিঙিয়ে কোনো কোনো মূল ধারার মিডিয়াতেও লক্ষণীয়।
ভোটার দেশগুলোর ভোটেই জাতিসংঘ নামের বিশ্বসভা তাদের মানবাধিকার কাউন্সিলে সদস্য করেছে বাংলাদেশকে। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলকে নয়। আবার মানবাধিকারে ত্রæটি বা ব্যত্যয় নিয়ে তারাই সমালোচনাা করেছে বাংলাদেশেরই। সরকারকে দিয়েছে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর তাগিদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘাটতি থাকাতেই তো ঘাটতি পূরণের তাগিদ। জাতিসংঘের খাতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। তারওপর গত বছর র্যাব এবং এর সাবেক- বর্তমান ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তা প্রত্যাহারের আবেদন-নিবেদন অগ্রাহ্য করে চলছে তারা। বলছে পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর পরিস্থিতির একটু একটু উন্নতি হচ্ছে বলে স্বীকারও করছে। এ রকম সময়েই জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে, যা অনেকের হিসাবে মিলছে না। এ কারণেই একদিকে কুকথা, টিপ্পনি এবং আরেকদিকে চলছে বড়াই।
জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচলেট মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এটাই ছিল প্রথমবার জাতিসংঘের কোনো মানবাধিকার প্রধানের ঢাকা সফর। চলতি পথ নয়, হাইপ্রোফাইল সফর। ছিলেন চার দিন। এ চারদিনই কেটেছে তার কর্মব্যস্ততায়। ব্যাচেলেট ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বেশ কয়েক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কথা বলেছেন দেশে কর্মরত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। সরকারের দিক থেকে তাকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানানো হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়নের চেষ্টার কথা জানানো হয়েছে। এর বিপরীতে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাতিসংঘ থেকেও নিষেধাজ্ঞা জারির যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ পেয়ে গেছে বিশাল স্বীকৃতি, যা নিয়ে দেশে একটি বাঙালিপনা চলছে। একদিকে ক্ষমতাসীনদের উল্লাস, অন্যদিকে বিরোধীমহলে হা-পিত্যেস।
তাদের কাছে জাতিসংঘ এখন ভুয়া প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই বলে বার বার সতর্ক করে আবার কীভাবে তাদের কমিটির সদস্য নির্বাচিত করে- তা সহ্য হচ্ছে না তাদের। আর সরকার সমর্থিতরা মনে করেন, সরকার জিতে গেছে। বেশি ভোট পাবার যোগ্যতা রাখে বলেই তো বাংলাদেশ এতো ভোট পেয়েছে। এতো দেশের ভোট কি রাতে হয়েছে? আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগকর্মীরা কি সেখানে গিয়েও ভোট জালিয়াতি করেছে? এ ধরনের স্তুতিমিূলক প্রশ্ন ছুড়ছে। যেন বাংলাদেশ এবারই প্রথম এ সদস্য পদ পেয়েছে, এমন একটি মতিগতি তাদের। বিষয়টি মোটেই এতো সরলীকরণের নয়। এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং প্রতিশ্রæতির প্রতি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের স্বীকৃতির প্রকাশ।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ (ইউএনএইচআরসি) নির্বাচনে ১৯৩টি সদস্যদেশের মধ্যে মোট ভোট দিয়েছে ১৮৯টি দেশ। ভোটাভুটিতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬০টি ভোট পেয়ে পঞ্চমবারের মতো সদস্য নির্বাচিত হয়েছেদ বাংলাদেশ। মানবাধিকার পরিষদে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শূন্য হওয়া চারটি আসনের বিপরীতে এবার বাংলাদেশসহ প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছে ৭টি দেশ। একটি দেশ বাহরাইন কয়েক দিন আগে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতায় ছিল বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম, কিরগিজস্তান, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া। বাংলাদেশ ছাড়া এ অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হয় মালদ্বীপ (১৫৪), ভিয়েতনাম (১৪৫) ও কিরগিজস্তান (১২৬)। জাতিসংঘের এই সংস্থায় এর আগে ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। এবার ভোটাভুটিতে নতুন করে ১৪টি দেশ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত দেশের তালিকায় রয়েছে আলজেরিয়া, বেলজিয়াম, চিলি, কোস্টারিকা, জর্জিয়া, জার্মানি, কিরগিজস্তান, মালদ্বীপ, মরক্কো, রোমানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান ও ভিয়েতনাম। নির্বাচিত এসব দেশ ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। তাই বলে বিষয়টি হালকা করে দেখার মতো নয়। আবার উল্লাসে মেতে প্রতিপক্ষ বধ করার বিষয়ও নয়। দেশের জন্য কঠিন সময় এটি একটি প্রাপ্তি, যা না পেলে বোঝা যেত হাড়ে-হাড়ে।
গুম, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ভর্ৎসনার মাঝে এ প্রাপ্তি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের, একই সঙ্গে সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। দায়িত্বের সতর্কবার্তাও। মানবাধিকার কাউন্সিলের কাজ হচ্ছে সারাবিশ্বে সদস্য দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা তৈরি করা। সরকার বিরোধীরা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ উল্লেখ্য করলেও বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত দেশগুলোর একটি। সাধারনভাবে দেখলে, এই বিজয় আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ এবং বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি বাড়াবে। কিন্তু একই সঙ্গে সরকারের জন্য বাড়তি চাপও তৈরি করবে। নানা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখভালের দায়িত্ব যে কাউন্সিলের তার কোনো সদস্য রাস্ট্রের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ নিশ্চয় শোভন হবে না। ফলে বাংলাদেশকে এই ব্যাপারে অধিকতর সংবেদনশীল এবং মনোযোগী না হয়ে উপায় থাকবে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ভোটে সদস্য রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ এবং বর্তমান সরকারের প্রতি যে আস্থা দেখিয়েছে, সরকার সেই আস্থার সম্মান রাখতে না পারলে কঠিন পরিণতিতে পড়বে। পাশাপাশি জাতিসঙঘের জন্য প্রজোয্য বার্তাও কম নয়। তথ্য এবং পরিসংখ্যানই সেই বার্তা দিচ্ছে।
নতুন নির্বাচিত সদস্য দেশগুলোর মাঝে অনেকগুলোর নাজুক অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর সর্বশেষ প্রকাশিত মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভিয়েতনামের অবস্থান ১৭৪তম, বাংলাদেশের ১৬২তম, সুদান ১৫১তম, মরক্কো ১৩৫তম আলজেরিয়া ১৩৪তম, জর্জিয়া ৯১তম। ১৬৫টি দেশ ও ২টি অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০২১ সালের যে গণতন্ত্র সূচক তৈরি করেছে সেই তালিকাতেও এই দেশগুলোর অবস্থান তলানিতে। সেখানে সুদানের অবস্থান ১৪৫, ভিয়েতনাম ১৩১, আলজেরিয়া ১১৩, মরক্কো ৯৫, জর্জিয়া ৮৯, বাংলাদেশ ৭৫। এছাড়া ‘হিউম্যান ফ্রিডম ইনডেক্স’ এ ১৬৫ দেশের তালিকায় এই দেশগুলোর অবস্থান একেবারে তলানিতে (সুদান ১৬২, আলজেরিয়া ১৫৪, বাংলাদেশ ১৪২, মরক্কো ১৩৪, ভিয়েতনাম ১৩৪)।
বাংলাদেশ মোটেই সেই কাতারে নয়। আবার উন্নত দেশের উদাহরণও নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সব গনতন্ত্রেরই দুর্বলতা আছে। তাদের দুর্বলতায় আবার সৌন্দর্যও আছে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা রাজনীতিকরা, ক্ষমতাসীন সরকার তাদের দুর্বলতা প্রকাশ্যে স্বীকার করে, সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে। এই চেষ্টাটা দৃশ্যমান। তারা অন্য কাউকে এর জন্য দোষারোপ করে না, বলে না তাদের সরকারকে নিষেধাজ্ঞায় ফলেতে। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমের দেশগুলো মানবাধিকার লংঘন, পুলিশী নির্যাতনের ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করে না। বরং কেউ কোনো দাবি তোলার আগেই সংশ্লিষ্ট বিভাগ পদক্ষেপ নেয়। কখনো কখনো ঘটনাগুলো একেবারে সরকারি সূত্রেই প্রকাশিত হয়। এতে ঘটনা বিকৃত হয় না বা হতে পারে না।
পরিশেষে, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাচনে বাংলাদেশের এই নিরঙ্কুশ জয় কিন্তু মোটেই মসৃণ ছিল না। কারণ, দেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা বিতর্ক ও প্রশ্ন থাকায় বিষয়টা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জের, তাই এটা ছিল প্রত্যাশার চেয়েও বড়ো প্রাপ্তির। বাংলাদেশের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা যতটা না আত্মতৃপ্তির, এর চেয়ে বেশি আত্মপোলব্ধির।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন