চলন্ত বাসে মেয়েদের ‘উত্ত্যক্তের’ প্রতিবাদ করায় মো. রাব্বি নামের এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। একই ঘটনায় আহত হয়েছেন রাব্বির বন্ধু মো. শাওন নামে আরেক তরুণ। গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর আসাদগেট এলাকায় বাসের মধ্যে এই ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে গত সোমবার মুগদার মান্ডা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব মীমাংসা করে দেয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে মো. রাকিবুল ইসলাম রাতুল (১৯) নামের এক শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাতুল মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল এন্ড কলেজের ইন্টারমিডিয়েট প্রথমের বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্থানীয় গ্যাংয়ের লিডার হিরা ও রবিউল গ্রুপ ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাতুলকে কুপিয়ে হত্যা করে। দু’টি হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশ জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি। রাজধানীতে ৫৪ গডফাদারের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ৮৬ কিশোর গ্যাংয়ের ২৫০০ হাজার সদস্য নিত্যদিনই করে যাচ্ছে একের পর এক অপরাধ হত্যা, ছিনতাই, অপহরণ, ইফটিজিং ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ। ওই গডফাদারদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী। আছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও।
অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেকে গ্যাং কালচারের দিকে ধাবিত হয়। ফলে সামগ্রিক প্রচেষ্টা নেয়া না হলে কিশোর গ্যাংয়ের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে না। বয়সে কিশোর হওয়ার সুবাধে শাস্তির আওতায় আনতে আইনের যথেষ্ট ফাঁকফোকর থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে এসব গ্যাংয়ের লিডারসহ বাকি সদস্যরা। অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটিয়েও বয়সের অজুহাতে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে জামিনে বের হওয়ার সুযোগ। জামিনে বাইরে এসে এরা আবারও জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।
পুলিশের প্রস্তুত করা একটি ডাটাবেজ দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার রয়েছে আওয়ামী লীগের ১১ জন, ছাত্রলীগের ১৬ জন, স্বেচ্ছাসেবকলীগের ৫ জন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ৪ জন, যুবলীগের ৭ জন, বিএনপি’র ১ জন, যুবদলের ১ জন, শ্রমিক লীগের ১ জন এবং রাজনৈতিক পরিচয় নেই এলাকায় প্রভাবশালী এমন ৫ জন। গডফাদাররা কিশোর গ্যাংকে অর্থ ও দেশীয় অস্ত্র সরবরাহও করে। এছাড়া সকল অপরাধ করতে উৎসাহ দেয়। মহল্লা-বস্তির ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে ধনাঢ্য পরিবারের ধনীর দুলালদের সমন্বয়ে গড়া বেশ কিছু গ্যাংয়ের সদস্যদের কাছে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র। মাঝেমধ্যেই গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে অন্য এলাকাতেও মহড়া দিচ্ছে বলে খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর হওয়ার কারণে দণ্ডবিধিতে পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের কেউ অপরাধ করলে তাকে দণ্ডবিধিতে কোনো বিচারকার্য সম্পাদন করা যাবে না। তাদের আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হয়। অথচ ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রায় ২০০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীতে কিশোর গ্যায়ের সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, উঠতি বয়সি ছেলেরা নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ছোটখাটো ছিনতাই থেকে শুরু করে মাদক সেবন, মেয়েদের টিজ করা এমনকি নিজেদের মহল্লায় জুনিয়র-সিনিয়র সংঘাতে খুন পর্যন্ত হচ্ছে। সম্প্রতি এটা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে এখন এটা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তাই শুধু পুলিশ একা নয়, যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন তাদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের উচিত হবে সমস্যা লুকিয়ে না রেখে তারা যেন যথাসময়ে পুলিশের সহায়তা নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এর কারণ নিরূপণ করা জরুরি। নানা কারণে কিশোর শ্রেণি বিপথে ধাবিত হয়। এ জন্য সমাজে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস, মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানবিক আচরণ জরুরি। শুধু পুলিশ দিয়ে নয়, সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও অনেকে গ্যাং কালচারের দিকে ধাবিত হয়। ফলে সামগ্রিক প্রচেষ্টা নেয়া না হলে কিশোর গ্যাংয়ের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
ভয়ংকর ৮৬ কিশোর গ্যাংয়ের ২৫০০ সদস্য : ডিএমপির একাথিক মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত সব নামের কী মর্মার্থ তা অনেকেরই জানা নেই। তবে নামের ধরন দেখে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যে কারও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লিডারের নামে গ্রুপের নামকরণ হয়ে থাকে। ইভটিজিং, মারধর, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও মাদক ব্যবসা, ছিনতাই এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং। তাদের উৎপাত আর অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাং সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, মাঠ পর্যায় থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। যাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা, সদস্য এবং পৃষ্ঠপোষকদের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এবারই প্রথম তালিকায় নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরের পাশাপাশি গ্যাং লিডারের ছবিও সংযুক্ত করা হয়েছে।
পুলিশের হালনাগাদ তালিকায় সদস্যদের পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক বা রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক পদ, পদবি ও নাম-ঠিকানাসহ এবং মোবাইল নম্বর যুক্ত করে কে কোন গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক তার বিস্তারিত বিবরণও রয়েছে এ তালিকায়। এতে যেসব রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে তাদের বেশির ভাগই পাড়া-মহল্লার উঠতি নেতা বা পাতিনেতা হিসাবে পরিচিত। এছাড়া বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম আছে তালিকায়।
৮৬ কিশোর গ্যাং : রাজধানীর উত্তরা বিভাগে মোট ১১টি গ্রুপ পুলিশের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এগুলো হলো-নাইন স্টার, এইচবিটি আ হিটার বয়েজ, সানি গ্রুপ, ইয়ংস্টার গ্রুপ, বিগ বস গ্রুপ, রানা ভোলা কিং মহল, জিদান গ্রুপ, শাহীন গ্রুপ, রিপন গ্যাং, সলেমান গ্যাং, দি বস (হৃদয় গ্যাং) গ্রুপ। এই ১১টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৩২০জন। গুলশান এলাকায় ডি নাইন নামের মাত্র একটি গ্রুপ শনাক্ত করেছে পুলিশ। এর সদস্য সংখ্যা ৩০ জনের বেশি।
তেজগাঁও বিভাগে সক্রিয় গ্রুপ ১৭টি। এর সদস্য সংখ্যা ১০৫০ জন। গ্রুপের নামগুলো হলো-কানা জসিম গ্রুপ, মাইন উদ্দিন গ্রুপ, শাকিল গ্রুপ, মামুন গ্রুপ, লাড়া-দে, চিনে ল, কোপাইয়া দে, সেøাগান গ্রুপ, বাঁধন গ্রুপ, পলক গ্রুপ, গাংচিল গ্রুপ, ঘুটা দে, চেতাইলেই ভেজাল, দ্যা কিং অব গাইরালা, ভইরা দে এবং অনলি কোপাইয়া দে গ্রুপ। এই ১৭টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০৫০জন।
এছাড়া মিরপুরে সক্রিয় ২৩টি গ্রুপ। এগুলো হলো-অপু গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, নাডা ইসমাইল, হ্যাপি, বগা হৃদয়, ভাস্কর, রবিন, এল কে ডেভিল বা বয়েজ এল কে তালতলা, পটেটো রুবেল, অতুল গ্রুপ, আশিক গ্রুপ, জল্লা মিলন গ্রুপ, রকি, পিন্টু-কাল্লু গ্রুপ, মুসা হারুন গ্রুপ ওরফে ভাই ভাই গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, সোহেল গ্রুপ, ইসামিন, ইমন ও জুয়েল গ্রুপ। এই ২৩টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১২০জন।
রমনা বিভাগে ৮টি গ্রুপের নাম হচ্ছে বেইলী কিং রন, অলি গ্রুপ, জসিম, লাভলেন, বাংলা গ্রুপ, পারফেক্ট গ্যাং স্টার বা পিজিএস, সুমনের গ্রুপ এবং লাড়া-দে। এই ৮টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১৪০জন।
এছাড়া ওয়ারী বিভাগের ৬টি গ্রুপ চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে-শুক্কুর গ্রুপ, লিটন গ্রুপ, তাহমিদ গ্রুপ, পলাশ গ্রুপ, মোল্লা গ্রুপ এবং সাঈদ গ্রুপ। এই ৬টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০০জন।
রাজধানীর ব্যাংকপাড়া হিসাবে পরিচিত মতিঝিল এলাকায় ১১টি কিশোর গ্যাং পুলিশের তালিকাভুক্ত। এগুলো হলো Ñমিম গ্রুপ, চাঁন যাদু গ্রুপ, ডেভিল কিং গ্রুপ, ফুল পার্টি, জিসান গ্রুপ, বিচ্ছু বাহিনী, আকিল ও অন্নয় গ্রুপ, নিবির গ্রুপ, মাসুদ গ্রুপ। এছাড়া সক্রিয় আরও ৩টি গ্রুপের নাম জানা যায়নি। এই ১১টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৯০জন। লালবাগ বিভাগে সক্রিয় ৬টি গ্রুপ। এগুলো হলো জুম্মন গ্রুপ, বহুল আলোচিত টিকটক হৃদয়, আহম্মেদ পাত্তি গ্রুপ, ইয়ামিন, ফায়সাল ও নাসির গ্রুপ। এই ৬টি কিশোর গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১৫০জন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন