মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য ৫টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাসস্থান অন্যতম। বিশেষত, আমাদের ক্রমবর্ধমান শহরায়ন ও নাগরিক জীবনে আবাসন সমস্যা অন্যতম নাগরিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। নানা সংকট ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতির পরিধি ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার পুরোটা অর্জিত না হলেও বৈদেশিক রেমিটেন্স আয়সহ আমদানী-রফতানী বাড়ছে, বাড়ছে অবকাঠামো উন্নয়ন বাজেটও। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকিসহ অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। তবে আবাসন খাতের সংকট নিরসনে কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সংকটসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ২০০৮-৯ সালে আবাসনখাতে মন্দার প্রভাব প্রকট আকারে লক্ষণীয় হয়ে উঠার সাথে সাথে এ খাতে বাড়তি নজরদারি, বিনিয়োগ ও প্রাসঙ্গিক বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হলেও গত ৬-৭ বছরে এমন কোন সরকারী পরিকল্পনা দেখা যায়নি, যা’তে আবাসন খাতের উদ্যোক্তা ও গ্রাহকরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পাবে। মূলত, গত দেড় দশক ধরেই আবাসন খাতের বিনিয়োগে ঝুঁকি ক্রমশ বেড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে জমির মূল্য ও বেচা-বিক্রি যেমন কমেছে, সেই সাথে ফ্ল্যাটের মূল্য এবং ব্যাংকের সুদের হার কমানোর পরও আবাসন খাতের মন্দা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এমনকি অপ্রদর্শিত আয় আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রেখেও পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন বা সুফল পাওয়া যায়নি।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়- ২০০১ থেকে পরবর্তী এক দশকে জিডিপিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়সহ আবাসন খাতের অবদান প্রতি বছরই ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০১ সালে যেখানে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ছিল জিডিপি’র ৮.৬৩ ভাগ, সেখানে ২০১০ সালে এসে তা ৭.২০ ভাগে নেমে এসেছে। ২০১০ সালের পর আবাসন খাতের সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। অথচ এ সময়ে সরকারী হিসাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এবং ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। আবাসন খাতে অর্থনীতির সে ইতিবাচক ধারার প্রভাব পড়েনি। তবে এ সময়ে ঢাকায় বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অন্যদিকে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই কমপক্ষে ১০ হাজার তৈরী ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়ে গেছে। এটি শুধু রিহ্যাব সদস্য বা তালিকাভুক্তদের হিসাব। এর বাইরেও অনেক হাউজিং কোম্পানী আছে যারা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিপদে পড়েছে। রিহ্যাবের সাম্প্রতিক দাবী অনুসারে, দেশের আবাসন খাতের সামগ্রিক বিনিয়োগের অঙ্ক ২ লক্ষাধিক কোটি টাকা এবং কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে জানা যায়। আবাসিক খাতের সহযোগী ও লিঙ্কেজ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। নির্মাণাধীন হাউজিং প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের ভবিষ্যত নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণে জটিলতা, উচ্চ সুদ হার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগে অনিশ্চয়তা, সময়ক্ষেপণ ও নানাবিধ হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা আবাসন খাতের বাজার চাঙ্গা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
আবাসন খাতের সংকট ও মন্দাবস্থা নিরসনে এ খাতের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যে সব উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত সরকারী পর্যায়ে গৃহীত হওয়ার পরও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমানোর পাশাপাশি ফ্ল্যাটের মূল্য কমিয়ে দেয়ার পরও হাজার হাজার ফ্ল্যাট বছরের পর বছর ধরে অবিক্রীত থাকার নেপথ্য কারণসমূহ খতিয়ে দেখতে হবে। আবাসনখাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখার কথা বলা হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগসহ সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় হয়রানি ও বিড়ম্বনার ভয়ে বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে। দেশের হাজার হাজার প্রকৌশলী, স্থাপত্য, সিমেন্ট শিল্প, রি-রোলিং মিলস, ইট ভাটা, বালু, টাইলস-সিরামিক, পাথর, পরিবহন, পাইপ, ফিটিংস, ক্যাবলস, কাঁচ, অ্যালুমিনিয়াম ফিটিংসসহ বিভিন্ন সেক্টরের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা দূর হলে দেশের অর্থনীতিতেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই সাথে প্রায় ২ কোটি মানুষের ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত ও অপ্রতুল আবাসন ব্যবস্থার কারণে যে নাগরিক বিড়ম্বনা ও পরিবেশগত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করে একটি সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আবাসন খাতের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষত, আবাসন খাতে গ্যাস লাইন ও বিদ্যুতের সংযোগ অবারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ফ্ল্যাট নিবন্ধনের খরচ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ গুরুত্বপূর্ণ খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ কোটি মানুষের আবাসন চাহিদা পূরণে সরকারের সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনার বিকল্প নেই। দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত, সহজসাধ্য ও লাভজনক রাখা সম্ভব হলে আবাসনখাতের স্থবিরতা কাটিয়ে দেশের অন্যতম বুমিং খাত হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেই চলবে না, বিনিয়োগকারী বা ক্রেতা-বিক্রেতাদের হয়রানি, ঝুঁকি ও অনাস্থা দূর করার বাস্তব উদ্যোগও নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন