চীনা প্রকৌশলীরা শিগগিরই বাংলাদেশের তিস্তা নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রায় ১০ হাজার ১৭০ কোটি বাংলাদেশি টাকা) প্রকল্পে কাজ শুরু করতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তা লক্ষ্য পূরণের জন্য ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করলেও উদ্যোগটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে মেগাপ্রজেক্টের অগ্রগতি স্থগিত ছিল এতদিন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত মাসে নদীটি পরিদর্শন করে বলেন, পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়না (পাওয়ার চায়না) এর প্রকৌশলীরা কাজের এলাকা পরিদর্শন করছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আশা করি আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিস্তা মেগাপ্রজেক্ট শুরু করতে পারব।
মন্তব্যগুলো ছিল ২০২২ সালের জুলাই মাসের পর প্রথম বড় উন্নয়ন, যখন বাংলাদেশ ঘোষণা করে যে, তারা চীন থেকে ৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ঋণের জন্য আবেদন করেছে। সঠিক পরিমাণ এখনও চূড়ান্ত না হলেও বাংলাদেশ মোট খরচের ১৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে বহন করতে পারে।
রাষ্ট্রদূত লি-এর বক্তব্যকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রকল্পটির অগ্রগতির লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে - যদিও ধীরগতিতে।
নয়াদিল্লির সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ভারত থেকে বয়ে যাওয়া নদীটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ঢাকা চীনের দিকে ঝুঁকেছে। ২০১১ সালে সম্মত একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আপত্তির কারণে পরিত্যক্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়েই নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশের আগে প্রবাহিত হয়।
এশিয়া ফাউন্ডেশনের ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য তিস্তার উপর নির্ভর করে, নদীর বন্যার সমভূমি বাংলাদেশের মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশ জুড়ে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে, গাজলডোবা ব্যারাজ এবং তিস্তা ব্যারাজসহ উজানে ভারতীয় সেচ প্রকল্পের ফলে পানির স্তর নেমে গেছে।
বাংলাদেশের পানিসম্পদ ও আবহাওয়া পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, বর্ষা মৌসুমে নদী বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষয় হয়, কিন্তু শুষ্ক মাসে এটি ‘মৃত’ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি হল ভারত শুধু প্রবাহকে সরিয়ে দিচ্ছে না, দেশের অন্যান্য অংশে পানি সরিয়েও নিচ্ছে, যা নিয়ে বাংলাদেশ খুব একটা খুশি নয়’।
বাংলাদেশের একজন পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বছরের বেশির ভাগ মাস পানির অভাবের কারণে তিস্তা অববাহিকায় মাত্র ৩৫ শতাংশ কৃষি জমি চাষ করা হচ্ছে। ‘আমরা অনেক মাছের প্রজাতি হারিয়েছি, যার ফলে শত শত জেলে চাকরি হারিয়েছে’, তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি অসহনীয়, অগ্রহণযোগ্য এবং বড় বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে’।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পে কাজের জন্য পাওয়ার চায়নার সাথে একটি নন-বাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে, যার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী ড. শামল চন্দ্র দাস বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে এমওইউ নবায়নের অনুরোধ করেছে এবং এটি প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে ড্রেজিং, ভূমি পুনরুদ্ধার, ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ এবং নদীর তীর রক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার।
পাওয়ার চায়নার একটি ভিডিও অনুসারে, ক্ষয় রোধ করতে গ্রোইনস, লেভিস এবং ক্রস বার স্থাপন করা হবে। নদীর তলদেশ থেকে পলি ও ধ্বংসাবশেষও ফেলা হবে। তিস্তা একটি ৫ কিমি (৩.১ মাইল) প্রশস্ত বিনুনিযুক্ত নদী, যার প্রধান চ্যানেলটি দ্বীপ দ্বারা বিভক্ত। প্রকৌশলটি প্রায় ১ কিমি চওড়া একটি সংকীর্ণ প্রধান চ্যানেলে এর প্রবাহকে বাধ্য করবে।
নিশাত বলেন, ‘যদি আপনি নদীকে সঙ্কুচিত করেন, তাহলে পানির স্তর বাড়বে এবং আপনি নদী থেকে পানি পাম্প করে সেচ দিতে পারবেন। ড্রেজ করা উপাদানটি নদীর উভয় পাশে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার জমি পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহার করা হবে, যা শহুরে কমপ্লেক্স, শিল্প এস্টেট এবং কৃষি উন্নয়ন অঞ্চলগুলো হোস্ট করবে।
কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, একটি বিনুনিযুক্ত নদীকে ‘সোজা’ করার চেষ্টা তার গতিবেগকে একটি সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য স্তরে বাড়িয়ে দেবে। ‘নদী এমন একটি উপাদান নয় যা আমরা নিজেরাই পরিচালনা করতে পারি। যদি একটি নদী প্রাকৃতিকভাবে বেণি করা হয়, তাহলে নদীর স্বাভাবিক প্রবণতা বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে’, বলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক মুনসুর রহমান।
তবে নিশাত বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নদীটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। ‘প্রকৌশল কাঠামোগুলো উচ্চ বেগ সহ্য করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হবে’।
আরেকটি উদ্বেগ হল পুনরুদ্ধারকৃত জমি থেকে কে উপকৃত হবে। বাংলাদেশের নদী ও ব-দ্বীপ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘নদীর বাসিন্দারা দৈনিক শ্রম ছাড়া অন্য কোনো সুবিধা পাবে না’। ‘যেকোনো শিল্প অঞ্চল তৈরি করলে বিনিয়োগকারী, সরকার এবং নির্মাণ শিল্পের পকেট ভরবে’।
পরিবেশ আইনজীবী হাসান বলেন, প্রকল্পের বিবরণ বিতর্কের জন্য জনসাধারণ বা শিক্ষাবিদদের সাথে শেয়ার করা হয়নি। চীনের সাথে ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লিও এ প্রকল্পে আপত্তি জানাতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন। চীনও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন।
১৩ অক্টোবর বাংলাদেশে এক সেমিনারে বক্তৃতায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি অকপটে বলেছিলেন যে, দেশটি ‘প্রকল্পটি নিয়ে কিছুটা অনিচ্ছুক’। ‘কারণ, অবশ্যই, কিছু সংবেদনশীলতা রয়েছে যা আমরা অনুভব করেছি’ তিনি ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ এবং ‘ভূ-রাজনৈতিক’ বিষয়গুলোর অভিযোগ উল্লেখ করে বলেছিলেন। সূত্র : এসসিএমপি নিউজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন