ময়ূর নদীকে বলা হয় খুলনা শহরের প্রাণ। অনেকেই বলেন শহরের হৃদপিÐ এই ময়ূর নদী। ভৈরব ও রূপসা নদীর মিলনস্থলে খুলনা মহানগরীর অবস্থান। রূপসা নদী থেকে একটি শাখা বেরিয়ে ময়ূর নামে শহরের ভেতরে প্রবেশ করেছে।
সমগ্র শহরের পানি নিষ্কাশনের কাজটি করে থাকে ময়ূর নদী। শহরের গৃহস্থ ও বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানির ৮০ শতাংশ ২২টি ড্রেনের মাধ্যমে প্রতিদিন এই নদে পড়ছে। বর্জ্য জমে ঘটছে পরিবেশ দূষণ। পানি দূষিত হয়ে পড়ায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। মহানগরে সৃষ্ট বর্জ্যরে সবটুকু নিষ্কাশনের সক্ষমতা নেই খুলনা সিটি করপোরেশনের। ফলে প্রতিদিন কঠিন বর্জ্যরে একটি বড় অংশ নালা-নর্দমার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাচ্ছে ময়ূর নদীতে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক দুটি গবেষণাপত্র ও পরিবেশ অধিদফতর খুলনা কার্যালয়ের রিভার ওয়াটার এনালাইসিস শিট থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায় , বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুসারে অভ্যন্তরীণ ভ‚-পৃষ্ঠের পানির বিশুদ্ধতার মানদÐ নির্ধারণ করা হয় সাধারণত পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেনের পরিমাণ, প্রাণ রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা ও পানিতে দ্রবীভ‚ত ভৌত উপাদানের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে। গত এপ্রিল মাসে ময়ূর নদ থেকে পরিবেশ অধিদফতরের সংগ্রহ করা নমুনার জরিপে দেখা যায়, পানি বিশুদ্ধতার মানদÐ ও আদর্শ সীমার সঙ্গে ওই নদের পানির ব্যাপক তারতম্য রয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য মতে, বর্তমানে ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি লিটারে দশমিক ২ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। অথচ আদর্শ মাত্রা বিবেচনায় প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কম হওয়ায় এই নদীর পানি জলজ প্রাণী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পানিতে মিশ্রিত বর্জ্য বিয়োজিত করতে অনুজীবগুলোর যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার হয়, তাকে বিওপি বলা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পানির আদর্শ বিওডি হলো প্রতি লিটারে ৬ মিলিগ্রাম। এই মান ১০-এর ওপরে গেলে সেই পানিকে দূষিত পানি হিসেবে ধরা হয়। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য বলছে, বর্তমানে ময়ূর নদের পানির বিওডির মাত্রা প্রতি লিটারে ৭৮ থেকে ৮৬ মিলিগ্রাম, যা আদর্শ মানদÐের সীমা থেকে বহুগুণে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পানিতে দ্রবীভ‚ত ভৌত উপাদানের আদর্শ পরিমাণ (টিডিএস) প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রাম। এই মাত্রা এক হাজারের ওপরে গেলে সেই পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী ধরা হয়। আর পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ময়ূর নদের প্রতি লিটার পানিতে সর্বোচ্চ ৬০৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত টিডিএস পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদফতরের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, খুলনায় সবচেয়ে বেশি দূষণ এখন পানিতে। বিশেষ করে শহরের পার্শ্ববর্তী নদীর পানির মান অনেক বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর ময়ূর নদের পানির দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। ময়ূর নদের পানি নিয়ে ২০১৩ ও ২০২০ সালে পৃথক দুটি গবেষণা করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা দুটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের গবেষণায় আমরা পেয়েছিলাম, ময়ূর নদের পানিতে অতিমাত্রায় টিডিএস রয়েছে। ফলে ওই পানি বেশ দূষিত ও গন্ধযুক্ত ছিল। তবে ওই নদের মাটির পুষ্টি গুণাগুণ বেশ ভালো পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে মাটির যেসব গুণাগুণ পাওয়া গিয়েছিল তা কৃষিকাজের জন্য বেশ উপযোগী ছিল। কেসিসি বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকলে এ নদীর পরিবেশ ভালো থাকত। তিনি বলেন, ২০২০ সালে আমাদের গবেষণাটি ছিল মূলত খুলনা শহরের পানির নিরাপত্তা নিয়ে। এ গবেষণায় আমরা পেয়েছিলাম, খুলনা শহরের পানির চাহিদা মেটাতে ময়ূর নদকে বিশুদ্ধ পানির আধার হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
খুলনার বিল পাবলা এলাকা থেকে রূপসার আলুতলা পর্যন্ত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। আলুতলায় ১০ ভেন্টের একটি গেট তৈরি করে এটির প্রবাহ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে এখানে কোনো জোয়ার-ভাটা হয় না। খুলনা শহরের মধ্যে এই নদের ৬টি শাখা ছড়িয়ে আছে। শহরের গৃহস্থ ও বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানির ৮০ শতাংশ ২২টি ড্রেনের মাধ্যমে এই নদে পড়ছে। ফলে এখানে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, নদটি সংস্কার করে বর্ষা মৌসুমে স্বাদু পানি ধরে রাখা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে বছরজুড়ে সেই পানি দিয়ে শহরের মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো যাবে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারভেন্সি অফিসার আব্দুল আজিজ বলেন, শহরে প্রতিদিন ১২০০ থেকে ১২৫০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মেডিক্যাল বর্জ্যই থাকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ টন। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা প্রতিদিন ৮০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ফেলে আসেন। বাকি ৪০০ থেকে ৪৫০ টন বর্জ্য ড্রেন বা ফাঁকা জমিতে শহরের মানুষ ফেলে দেয়। শহরের সব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ও কর্মী নেই। আমাদের ৩১টি ওয়ার্ডের সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশন থেকে প্রতিদিন ১৯৮ জন স্থায়ী ও ৭১০ জন অস্থায়ী কর্মী বর্জ্য অপসারণ করেন। নগরবাসীর উচিত, ড্রেনে বা ফাঁকা জমিতে ময়লা না ফেলে কেসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশনে ফেলা।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় ময়ূর নদীতে জোয়ার ভাটা হত। নানা রকম মাছ পাওয়া যেত। নৌকা চলত। এখন সব অতীত। নদীটি অনেক জায়গায় খননের অভাবে ভরাট হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গা ভরাট হয়েছে ময়লা আবর্জনা জমে। যেটুকু পানি আছে তা বিষাক্ত হয়ে গেছে। শরীরে লাগলে চুলকানীসহ নানা রকম চর্ম রোগ হয়। দুর্গন্ধে আশেপাশে বসবাস করা যায় না। মশা ও পোকা মাকড়ের উপদ্রব তো রয়েছেই। অবিলম্বে তারা নদীটি খননের মাধ্যমে প্রাণ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন