ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা বরাবরই বন্যা-প্লাবিত হয়ে আসছে। এবং সময়ের সাথে বন্যার পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়ছে। জাকার্তার কিছু অংশ প্রতি বছর ২৫ সেন্টিমিটার (দশ ইঞ্চি) হারে সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে। একই ধরনের সমস্যা ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশেও দেখা দিচ্ছে। ২০২০ সালে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় দেশটিতে কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় ৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বন্যা গত বছর দ্বীপপুঞ্জটির ৬ লাখেরও বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। গত মাসে স্কুল ধসে পড়ে দেশটিতে তিনজন ছাত্র মারা গেছে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে যে, এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ৪২ লাখ ইন্দোনেশিয়ান স্থায়ী বন্যার সম্মুখীন হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার শুষ্ক ঋতুগুলোও সমস্যার বাইরে নয়। সেসময় তীব্র খরার কারণে বনে আগুন লেগে ইন্দোনেশিয়ার ২৩ কোটি একর বনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বিপদের সম্মুখিন ইন্দোনেশিয়াতে পরিবর্তন ঘটানোর দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন দেশটির আলেম সমাজ। ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী এবং এর অর্থনীতি দুটি অত্যন্ত দূষণকারী শিল্প কয়লা এবং পাম তেল রফতানির ওপর নির্ভরশীল। তাই একটি পরিচ্ছন্ন অর্থনীতিতে উত্তরণ দেশটির জন্য দীর্ঘ এবং কঠিন। কিন্তু এর ইমামরা সেই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে এগিয়ে এসেছেন।
ইন্দোনেশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও এখানকার আলেমরা ব্যাপক প্রভাব রাখেন। স্থানীয় গবেষণা সংস্থা কাতাডাটা ইনসাইট সেন্টারের ২০২০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়ানরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্যের ওপর সর্বোচ্চ আস্থা রাখে।
সেই আস্থাকে কাজে লাগিয়ে জুলাই মাসে একটি টেকসই ইন্দোনেশিয়া গঠনের জন্য দেশটির শীর্ষস্থানীয় ইসলামিক প্রতিনিধিরা জাকার্তার ইস্তিকলাল মসজিদে একত্রিত হয়ে মুসলিম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আলেম, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে ইসলামী পরিবেশগত সক্রিয়তাকে সমন্বয় করার জন্য একটি ফোরাম। ইন্দোনেশিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট মারুফ আমিন ব্যক্তিগতভাবে একজন মাওলানা হিসেবে পরিবেশগত ফতোয়া খসড়া তৈরি ও রক্ষায় জড়িত ছিলেন। তিনি তার রাজনৈতিক অবস্থান ব্যবহার করে সবুজ ধর্মোপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। ইস্তিকলালের গ্র্যান্ড ইমাম নাসারউদ্দিন ওমর সমাবেশে ঘোষণা করেন, একটি মসজিদ হওয়া উচিত মন ও হৃদয়কে সবুজ করার জায়গা। নিজের মসজিদে সোলার প্যানেল ও ওয়াটার রিসাইক্লিং সিস্টেম বসিয়ে তিনি পরিবেশ পরিবর্তনের কার্যক্রমটি শুরু করেছেন। ইন্দোনেশিয়াতে আরো এক হাজার মসজিদে সোলার প্যানেল এবং স্মার্ট এনার্জি মিটার লাগানো হবে।
ইস্তিকলাল দেশটির ক্রমবর্ধমান পরিবেশ আন্দোলনের একটি অংশ। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম ইসলামিক সংস্থা নাধলাতুল উলামা বর্জ্য এবং পুনর্ব্যবহার করার বিষয়ে একটি ধারাবাহিক খুৎবা চালু করেছে। এ ধরনের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংস্থা মুহাম্মাদিয়া তার ইমামদের ‘পরিবেশ প্রচারক’ হতে শেখানোর জন্য একটি কার্যক্রমও তৈরি করেছে। ধর্মীয় শীর্ষ সংস্থাও ইন্দোনেশিয়ার ওলামা কাউন্সিলও (মুই) এ আন্দোলনে জড়িত। গত এক দশকে এটি একের পর এক পরিবেশগত সবুজ ফতোয়া, বা বাধ্যতামূলক নয় এমন আইনি মতামত জারি করেছে। ২০১১ সালে এটি ইসলামী আইনের অধীনে পরিবেশগতভাবে ধ্বংসাত্মক খনিগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিন বছর পর এটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করে। ২০১৬ সালে এটি জুম চাষের অনুশীলনকে হারাম বলে নিন্দা করেছে।
ইন্দোনেশিয়ার ইসলামিক বোর্ডিং স্কুলগুলো ‘ইকো এণ্ড ইসলাম’ আন্দোলনের চারণভূমি হয়ে উঠেছে। এসব স্কুলে প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। প্রাক্তন ছাত্ররা প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেয়। জাভার দারুল উলুমে শিক্ষকরা নবী মুহাম্মদ (স.)-এর গাছ লাগানোর এবং বন্যপ্রাণী রক্ষার গল্প শোনান। স্নাতক হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের অবশ্যই একটি গাছ লাগাতে হবে (অন্যান্য জিনিসগুলোর মধ্যে)। আলেমরা অর্থায়নেও সক্রিয় হয়েছেন। সুদের ওপর শরয়ী নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার জন্য তারা ইন্দোনেশিয়ার ‘সবুজ সুকুক’ বা সবুজ বন্ড ডিজাইন করতে সাহায্য করেছে, যা নবায়নযোগ্য-শক্তি এবং আবহাওয়া-অভিযোজন প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন