সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

জাতীয় নির্বাচনেরআরও প্রায় এক বছরের বেশি সময় থাকলেও দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আগামী ডিসেম্বরকে সামনে রেখে রাজনীতিতে টউত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এতে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে ঘোলাটে হবে, তাতে সন্দেহ নেই।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বিএনপিকে রাস্তায় নামতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি ‘বাড়াবাড়ি’ করলে তাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে আবার জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মানবিক কারণে তাকে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই মানবতার বিপরীতে বিএনপি এখন সরকারকে হুমকি দিচ্ছে বলে সরকার থেকে বলা হয়েছে। যদিও আইনমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে আর জেলে নেয়া হবে না।

এদিকে বিএনপি এক দফা দাবি দিয়ে সরকার পতনের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন বিভাগে সমাবেশ করে যাচ্ছে। দলটির নেতাদের এক দাবী, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। সরকারকে পদত্যাগ করে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। বিভাগীয় সমাবেশ করার পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে দলটির। দলটির এক নেতা বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এবং তারেক রহমানের কথায়। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলা আদালতে নয়, রাজপথে সমাধান করবে, এমনকি আগামী নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন তার এক আইনজীবী। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। অবশ্য টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে নানা মাত্রা যোগ হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে তারা বড় জমায়েতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মনোবলে ধাক্কা দেয়ার কৌশল নিয়েছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে বলে দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে চাইছে। এ জন্য আওয়ামী লীগও রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পাল্টা বক্তব্য দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার হুমকিসহ ‘খেলা হবে’ বলে হুঙ্কার দিয়েছে। এসব পাল্টাপাল্টি হুঙ্কারের মধ্যে দেশ বা জনগণের স্বার্থ আছে কিনা তা বিবেচনার বিষয়। বলা হয়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আবার রাজনীতিকে কৌশলের খেলাও বলা হয়। সবই কি কথার কথা নাকি অন্য কিছু?

বিশ্ব রাজনীতিতে এখন একধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রাজনীতির গুণগত মান বদলে যাচ্ছে। ব্রিটেনে গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুবার প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। বরিস জনসন আস্থা ভোটে হেরে গেলে লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন। এর পর আসেন ঋষি সুনাক। তিনি দায়িত্ব নিয়েই অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য পূর্বসূরির সমালোচনা করেননি। আগেরবার যারা তার প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা দিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক কথাও বলেননি। কিংবা বক্তৃতা দিতে উঠেই বিরোধী দলের সমালোচনা করেননি। কেবল বলেছেন, এই জাতীয় সংকট নিরসনে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক চিত্র একেবারে বিপরীত। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রতিদিন মাঠে থাকছে। বিএনপির সিরিজ কর্মসূচিও চলছে। বিএনপি’র নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে। ভোলা, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, কিশোরগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, যশোরসহ দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
সামনে যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, তার আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপির সংঘর্ষ হলে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। রাজনীতির খেলার মাঠে জামায়াতে ইসলামী বিএনপি জোটে আর নেই ঘোষণার পর নতুন নামে নিবন্ধন পাওয়ার আবেদন এবং ফিরে আসার চেষ্টা খেলার অংশ হলে নির্ভয়ে থাকা যায় না। বরাবরই জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে ভাঙাগড়া ও নানা মেরুকরণের খেলা হয়। পর্দার আড়ালের খেলাও জমজমাট হয়। এবার নির্বাচনের এক বছর আগেই সেই খেলার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দল ও জোট গঠনের পাশাপাশি ভাঙনের সুরও শোনা যাচ্ছে। জাতীয় পার্টিতে এ ভাঙনের সুর বেশি। বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাও বেড়েছে। নানা গুঞ্জণ ডালপালা মেলছে। তার ওপর চলমান বিশ্ব উত্তেজনার মধ্যে ভয়ের বার্তাও রয়েছে।

১০ ডিসেম্বরের পরে কি হবে, এমন প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কথার কথা, মেঠো কথা-যা ই হোক, হুমকি-ধমকিমূলক কথা নানা প্রশ্নের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি করছে জনমনে। অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে যে পাল্টাপাল্টি ব্যক্তব্য চলছে, তাতে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনৈতিক সার্বিক পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলেছেন। নিত্যপণ্যের উচ্চদাম মারাত্মক পর্যায়ে। জ্বালানি ও বিদ্যুত সংকট, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন টানাপড়েনের মধ্যে, দিন দিন রিজার্ভ কমছে, এমন এক নাজুক পরিস্থিতি বিরাজমান। পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে সরকারের হিমশিম অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাবে।

কিছুদিন আগেও সমাবেশ দূরে থাক, বাসাবাড়িতেও থাকতে না পারা বিএনপি এখন সারাদেশে বিশাল বিশাল সমাবেশ করছে। এসব কর্মসূচিতে সরকারের বাধা দেয়ারও অভিযোগ উঠছে। শক্তি প্রদর্শনের মাত্রা ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়েই সরকার ও বিরোধীদল তাদের শক্তি দেখাতে চাইছে। সরকারি দল ব্যবহার করছে রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক শক্তিকে। বিএনপি শক্তির জানান দিচ্ছে, সরকারি বাধা ডিঙিয়ে সমাবেশ ঘটিয়ে। উভয় দলের এই শক্তি প্রদর্শন ভিন্নদিকে না যাওয়াই কাম্য। তবে সরকারের এই আগ্রাসী আচরণ নতুন নয়। রাস্তাঘাট বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার মতো ঘটনা বরাবরই ঘটেছে। এ কৌশল কখনোই মানুষ ভালো চোখে দেখে না। সমালোচিত হয়। এরপরও ক্ষমতায় থাকলে তা আমলে নিতে চায় না। আগের সরকার যে অপকর্মে তিরস্কৃত হয়েছে, সেই অপকর্ম তারাও করছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড দাপটের মধ্যে বিএনপি সমাবেশ ডেকে সহিংসতা করবে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে সরকারের আচরণে ভয় অথবা বিরোধীদলের রাজনীতিতে বাধা দিয়ে শক্তি প্রদর্শনের বাতিক ভর করেছে।

সময়টা এখন এমন যে, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তিক্ততার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হুমকি পাল্টা হুমকিতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের এই অপচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চলছে। সুস্থ্য রাজনীতি নেই বললেই চলে। রাজনীতির নামে চলছে, পারস্পরিক বিরোধিতা ও সংঘাত। গণতন্ত্রের প্রতি যাদের শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্ববোধ থাকে, তারা এমন আচরণ আর খেলাধুলার হুমকি দিতে পারে না। বর্তমানে দেশে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, দিন দিন মধ্যবিত্ত হয়ে যাচ্ছে নিম্নবিত্ত, বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, মানুষের আয় কমে গেছে, সমাজে নানা অস্থিরতা চলছে, এসব সমস্যা সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ যেখানে দ্রুত নেয়া দরকার, সেখানে চলছে রাজনৈতিক হুমকি-ধমকি। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
rintu108@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন