চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয় ইত্যাদি কারণেই বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিষয়টি দেশ-বিদেশে আলোচনা, গবেষণা, পর্যালোচনা চলছে। কারণ, খাদ্য সঙ্কটকে কেন্দ্র করে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিল তা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা দুরহ ও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা মানুষের জীবনের সাথে অতোপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত পরিবেশ, উন্নত জীবন সুন্দর ও টেকসই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পুষ্টি গুণসমৃদ্ধ খাবারের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ^ পরিস্থিতিতে আমাদের জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পালে মানবিক বিপর্যয়সহ নানা ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখনো ১৩.৬০ শতাংশ। দেশের উর্বর মাটি, কৃষি ও খাদ্য শস্য উৎপাদনের জন্য অনুকূল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এদেশে। শুধু ধান ও গম উৎপাদনে নয়, মাছ, সবজি, পশু পালন, গোশত উৎপাদন, আলু উৎপাদন, নানা ধরনের ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। এসব খাতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য থেকে দেখা যায়, ধান উৎপাদন, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র তৃতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ ও ছাগলের গোশত উৎপাদনের সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। পোলট্রি ও ডিম উৎপাদন মানুষের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বার্ষিক ডিম উৎপাদন ১ হাজার ৭০০ কোটি পিচ। কলা চাষেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। ইদানিং স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও পেয়ারার ভালো ফলন হচ্ছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র সপ্তম এবং বছরে আলু উৎপাদন হয় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। পুষ্টিকর খাদ্য দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন হয় এক কোটি ৬৮ লাখ টন। গোশত উৎপাদন হয় ৭৬ লাখ টন। উৎপাদনের এই অবস্থানকে আরো বৃদ্ধি ও গতিশীল করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগারি সহযোগিতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত না রাখলে সঙ্কট আরো ভয়াবহ হতে পারে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ অন্যতম শীর্ষস্থানীয় হলেও চালের উৎপাদন বাড়েনি। বিশেষজ্ঞরা আগামী বছর খাদ্য সঙ্কটের যে আভাস দিয়েছেন, সেটা মোকাবেলা করতে হলে চালের মজুদ বাড়াতে হবে। ধান উৎপাদনসহ কৃষি সামগ্রী ও শাকসবজি উৎপাদন বাড়াতে হবে। মৎস্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি সঙ্কট খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশ^ব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমতির দিকে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে ব্যাপকভাবে খাদ্য-ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক তথ্য থেকে জানা যায়, বাইরে থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে খাদ্য ঘাটতি বড় সঙ্কটের আকার নেবে। মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। আমাদের যে প্রচুর আবাদি জমি আছে, তা সঠিক ব্যবহার করার পাশাপাশি অনাবাদি জমিগুলোও আবাদযোগ্য করে উৎপাদন কাজে লাগাতে হবে। কৃষি এখনো অর্থনীতির প্রাণ। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে কৃষি ও কৃষকেরা সুরক্ষা পায়, সেদিকে জোর নজর দিতে হবে। কৃষি থেকে আসে শিল্পের কাঁচামাল। কৃষি উৎপাদন বিঘিœত হলে খাদ্য সঙ্কট ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। সামনে বিশ^ব্যাপী খাদ্য ও জ¦লানি সঙ্কট আরো গভীর হতে পারে। দীর্ঘদিন জ¦লানি সঙ্কট থাকলে খাদ্য উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদনসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতের সঙ্কট তৈরি হবে। বিশ^ব্যাংক বলেছে, সঙ্কুচিত মুদ্রার মান বিশ^ব্যাপী খাদ্য ও জ¦ালানি সঙ্কটকে আরো গভীর করতে পারে। বেশির ভাগ উন্নয়ন শীল দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়তে পারে। কৃষকেরা কৃষি পণ্যের উচিত মূল্য মধ্যস্বত্ব্যভোগীদের কারণে পায় না। কৃষিতে মুনাফা কম হওয়ায় নতুন প্রজন্ম এই খাতে আসতে চায় না। তাই পেশার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকে পেশা হিসাবে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। কৃষকেরা তাদের সন্তানদের এই পেশায় আনতে উৎসাহী নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি পণ্যের মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। এই খাতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। কৃষক প্রয়োজনীয় সার, বীজ ও কীটনাশক ব্যবহার করে যেন লাভের মুখ দেখতে পায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কৃষি খাতে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি সঙ্কট দূর করতে হবে। কৃষিঋণ সহজ লভ্য করাসহ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাঠ পর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে। কৃষি পেশায় লোকবলের সঙ্কট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে খাদ্য সঙ্কট তীব্রতর হবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বিবিএস সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট ফসলী জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। সেচের আওতা ৭৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর, পতিত ২ লাখ ২৩ হাজার। এক ফসলী জমি ২২ লাখ ৫০ হাজার, ২ ফসলি জমি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ও ৩ ফসলি জমির পরিমাণ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর। কৃষি গবেষকদের মতে, দেশে যে বিশাল আবাদযোগ্য জমি রয়েছে তা যদি পরিকল্পিতভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তাহলে বৈশি^ক এ মন্দাতেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান আরো বাড়ানো সম্ভব। কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো সার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৮ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১০ লাখ টন বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে। বেশি দামে সার আমদানি করে কম দামে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। যদিও কৃষি খাতে এই ভুর্তকি কতটা কৃষকেরা পায় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও পুষ্টির যোগান দেওয়ার জন্য ফল-ফলাদি, মাছ, গোশত, দুধ, ডিম, গম ও ভুট্টা উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ডিম ও মুরগি সরবরাহের উন্নতম খাত পল্ট্রি খাতের উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কৃষির উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়ন ও এ খাতের শ্রমিকদের কথাও ভাবতে হবে। কৃষকদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বাজার ব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে কৃষি সামগ্রী, সবজি, ফলমূলকে জনগণের মাঝে সহজ লভ্য করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার
main706@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন