অর্থনীতির মেরুদণ্ড রিজার্ভে আঘাত আসতে শুরু হয়েছে। এই আঘাত রুখে দিয়ে দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতির পথ সচল রাখতে হবে। বাংলাদেশ যেহেতু রেমিট্যান্স ও রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ, সেহেতু সর্বাগ্রে রেমিট্যান্সকে প্রাধান্য দিয়ে রিজার্ভের ভীত মজবুত করতে হবে। নতুন নতুন শ্রমবাজার খোলার জন্য রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দা। কাজ হারিয়েছে অগনিত মানুষ। পর্যাপ্ত কাজ নেই প্রবাসে। অসংখ্য প্রবাসী বেকার হয়ে আছে, বলতে গেলে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। করোনার ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি অনেক দেশ। এর মধ্যে রিজার্ভে ধস নামায় শ্রীলংকা দেউলিয়া হয়ে গেছে। রিজার্ভ না থাকার কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা রিজার্ভ শক্তিশালী থাকার কারণে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছিল। করোনা চলাকালীন বা তার পরবর্তীতেও বাংলাদেশে শক্তিশালী রিজার্ভ ছিল। তখন বাংলাদেশে রিজার্ভ যা ছিল তা দিয়ে একবছরের অধিক আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা ছিলো। আর বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী যা রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এটা মোটেই সুখকর বার্তা নয়। তবে এক্ষেত্রে আপাতত ভরসা এটাই, কোনো দেশের যদি তিন মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করার মতো রিজার্ভ থাকে, সেক্ষেত্রে সেই রিজার্ভ আদর্শ রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু রিজার্ভের এই নিম্নমুখীতা ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। তারপরও আশাবাদী আমরা, প্রবাসীরা যদি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে, অবৈধ চ্যানেলগুলি যদি বন্ধ করা যায় তাহলে রিজার্ভ আবারো বাড়বে। বর্তমান রিজার্ভের এই দূরাবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে হলে রিজার্ভের সংকট মোকাবিলায়ে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে রেমিট্যান্সের উপর। বৈধ চ্যানেলে যত বেশি রেমিটেন্স যাবে তত বেশি শক্তিশালী হবে রিজার্ভ। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনতে হলে বৈধ চ্যানেল ব্যবহারকারীদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিতে হবে। এইসঙ্গে রফতানি আয় বাড়াতে হবে এবং বিদেশি ঋণ সহায়তা ছাড় করতে হবে যত বেশি পারা যায়।
বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণের জন্য কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রথমত, বিনা চার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, প্রণোদনা বাড়িয়ে ৪% অথবা ৫% এ উন্নীত করা। তৃতীয়ত, তাৎক্ষণিক রেমিট্যান্স গ্রহণের সুবিধা নিশ্চিত করা। এই তিনটি বিষয়ে যদি রাষ্ট্র মনযোগী হয় তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। রিজার্ভের পরিমাণ ঊর্ধ্বগতি হবে। অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। উন্নয়ন অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। মজবুত অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষমতা অর্জন করবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ রেমিট্যান্স আহরণের জন্য জিরো চার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধা নিশ্চিত করেছে প্রবাসীদের জন্য এবং তাৎক্ষণিক রেমিট্যান্স গ্রহণের সুবিধাও নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণের পরও অপেক্ষা করতে হয়, কখন রেমিট্যান্স হাতে পাবে তার জন্য। তাই বেশিরভাগ প্রবাসী একান্ত বাধ্য হয়ে অবৈধ চ্যানেল ব্যবহারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর অবৈধ চ্যানেল হতে প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলমুখী করতে প্রণোদনা ৪% অথবা ৫% এ উন্নীত করতে হবে, কারণ, বৈধ চ্যানেলের রেট এবং অবৈধ চ্যানেলের রেট এর পার্থক্যর কারণে অনেকে অবৈধ চ্যানেলমুখী হয়। প্রণোদনা বাড়িয়ে দিলে রেটের অসামঞ্জস্যতা দূর হবে এবং প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেল বিমুখ হবে। বিনা চার্জে যদি রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধা পায় তবে সেক্ষেত্রে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে আরো বেশি আগ্রহী হবে। প্রবাস হতে যারা এক্সচেঞ্জ অথবা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে তাদের প্রতি ট্রানজেকশনে নির্দিষ্ট চার্জ দিতে হয়। যতবার টাকা পাঠাবে ততবারই চার্জ দিতে হয়। এক্ষেত্রে যদি বিনা চার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধা পায় তবে যারা চার্জের কারণে অবৈধ পথ ব্যবহার করে তারাও বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হবে। ধীরে ধীরে অবৈধ চ্যানেলগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। যত বেশি রেমিট্যান্স বৈধভাবে দেশে যাবে তত বেশি রিজার্ভ জমা হবে দেশের অর্থনীতিতে। যত বেশি রিজার্ভ জমা থাকবে দেশে ততবেশি অর্থনীতিতে শক্তিশালী হবে দেশ ।
বর্তমানে রিজার্ভের যে ধস তা ঠেকাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করা ছাড়া উপায় নেই। রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। রেমিট্যান্সের মাত্রা কমে যাওয়ায় কারণগুলো সূক্ষ্মভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রকে আলাদা ‘প্রবাসী সেল’ গঠনে মনযোগী হতে হবে । সংকুচিত শ্রমবাজার বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে উচ্চ পর্যায়ের যোগোযোগ চলমান রাখতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দিন দিন রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়বে। আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য রিজার্ভ মজবুত করা ছাড়া আপাতত বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। রিজার্ভ যত শক্তিশালী হবে যাবতীয় আমদানি ব্যয় মেটানো সহজ থেকে সহজ হবে। তাই রিজার্ভের দিকেই মনযোগী হতে হবে। অতএব পরামর্শ থাকবে রাষ্ট্রের প্রতি অর্থনৈতিক দুর্যোগ ঘনীভূত হওয়ার আগেই যেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। মোট কথা হলো, জনশক্তি রপ্তানি খাতকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, পরিকল্পিতভাবে দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠানো যায় এবং এই খাতের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্র যদি অধিক মনোযোগী হয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে সমস্ত অবৈধ চ্যানেল বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্র যদি সক্ষম হয়, বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলি যদি আরো বেশি আন্তরিক হয়, তবে রেমিট্যান্স আহরণ অনেক বেশি হবে। এইসঙ্গে রফতানি আয় বাড়াতে হবে এবং বিদেশি ঋণ সহায়তা দ্রুত ছাড় করতে হবে। তাহলে রিজার্ভের একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে উঠবে। আর কোনো ঝুঁকি থাকবে না।
লেখক: সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য, প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস), সংযুক্ত আরব আমিরাত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন