সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ব্যবসাবান্ধব নীতির বিকল্প নেই

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দায় বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়েছে। গত দুই যুগে কোনো বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশে থাবা বিস্তার করতে না পারলেও এবারই প্রথম নিষ্ঠুর বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কঠিন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ডলার সংকটে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছে না তারা। ফলে শিল্পকারখানায় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন অনেকাংশে কমে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। এতে ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

ব্যবসায়ীদের অভিমত, এ ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার কোনোভাবেই বাড়ানো যাবে না। সুদহার বাড়ালে ঋণগ্রাহক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা আরও বেশি চাপে পড়বে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুনিয়াজুড়ে কাঁচামাল, জাহাজ ভাড়া ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়লে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বাড়বে। কভিডের ধকল কেটে গেলেও শিল্প খাতে এখনো বাড়তি চাপ সামলানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাই সুদহার বাড়ালে নতুন খেলাপি তৈরির ঝুঁকি তৈরি হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবে, যা ব্যাংক ও উদ্যোক্তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের উৎসকে জিঁইয়ে রাখতে সরকারকে এ কঠিন সময়ে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে।

উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থছারে পরিমাণ কমেছে। কমেছে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স। বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তাও কমছে না। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপের মুখে। এই চাপ থেকে সহসাই যে মুক্তি মিলবে, এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। বরং এমন আশঙ্কা করা যেতে পারে যে, চাপ আরো বাড়বে। কারণ, আমাদের চাল-গম, সয়াবিন তেল, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এসব অপরিহার্য আমদানি পণ্যের জন্য প্রয়োজন ডলার।

ডলারসংকটের কারণে দেশের অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত তারিখে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না, বিলম্ব হচ্ছে। এলসির নিশ্চয়তা দেওয়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশি অনেক ব্যাংকই এখন বাংলাদেশের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ডলার ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ যে হারে কমছে, তাতে ডলারসংকট আরো তীব্র হবে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যর যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান হয়েছে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অক্টোবর শেষে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ এক হাজার ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। এতে সব মিলিয়ে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক সহায়তা আরো সংকুচিত হলে ডলারের সংকট আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স যে চাপ তৈরি করছে তা নিয়ে ভাবতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে রপ্তানি খাত, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, সহায়তা ও অনুদান। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সতর্ক হতে হবে। মুদ্রা বিনিময় হারের কার্যকর ব্যবস্থাপনা বের করতে হবে। বিশ্বের অন্য দেশগুলো নানা নীতি গ্রহণ করেছে। অনেক দেশ ডলারের মূল্য খোলাবাজারে ছেড়ে দিয়েছে।

তাদের মতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তিকর পর্যায়ে ধরে রাখাটাই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল মনোযোগ হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংককেই মূল ভূমিকা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চাহিদার সঙ্গে ডলার সরবরাহের সামান্য সমন্বয় করা যেতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন