আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। গণমানুষের মুক্তির জন্যই স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্যই ৩০ লাখ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করেছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের ধারণাই পাল্টে গিয়েছে। আমরা গণতন্ত্রকে হাস্যকর বস্তু বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের রাজনীতিবিদগণ গণতন্ত্র বিনিয়োগ করে অর্থ উপার্জন করে চলেছেন। অথচ, গণতন্ত্র হলো একটি রাষ্ট্রে বিরাজিত সামগ্রিক এক আদর্শের নাম, যা সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বত্রই বিকশিত হবার দাবি রাখে। সেটাকে আমরা আজ শুধুমাত্র নির্বচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। এমনকি বর্তমানে সে নির্বাচনটাকেও ধ্বংস করে ফেলেছি। আমরা ৭১-এ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। কারণ, তারা আমাদের সার্বিকভাবে বঞ্চিত করে রেখেছিল। আজও তাদের আমরা ঘৃণার চোখেই দেখে থাকি। কিন্তু আমরা সবাই জানি, তাদের অধীনেই ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সে নির্বাচনটি শতভাগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল। আর সেই নির্বাচনে বর্তমান আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী জান্তাদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও আমাদের নির্বাচন আমরা সুষ্ঠুভাবে করতে পারছি না। জাতি হিসেবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে! আমরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছি। জনগণের ভোটাধিকার বিলুপ্ত করেছি। আমাদের গণতন্ত্রকে এখন লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করেছি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পৈত্রিক সম্পদ মনে করে নিয়েছি। আর সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আমরা সম্পদের পাহাড় গড়েছি। সম্পদের মালিক হতে রাষ্ট্রক্ষমতাকে জোর করে দখল করে রেখেছি। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছি। আমরা গণতন্ত্র ধ্বংসের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করে ফেলেছি। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে আমরা গুম ও খুনের সংস্কৃতি চালু করেছি। মানবাধিকার খর্ব করেছি। এক কথায় বলতে গেলে, গণতন্ত্রকে আমরা গলাটিপে হত্যা করেছি। দেশ থেকে একদিকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে, অন্যদিকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার উধাও হয়েছে। ফলে দেশ আজ গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। তথাপিও রাজনীতিবিদদের গলাবাজি চলমান রয়েছে। ক্রমেই রাজনৈতিক মাফিয়াদের অসভ্য চেহারা ভয়ংকররূপে প্রকাশ পাচ্ছে। ‘নাই নাই খাই খাই’ অবস্থা তাদের সার্বক্ষণিকভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সময় যেন তাদের কাছ থেকে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তারা দ্রুত বড়ো লোক হবার নেশায় আখের গুছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। করোনার অর্থনৈতিক দুঃসময়েও তারা বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধি করেছে। এসময়ে দেশে ৬ হাজার নতুন কোটিপতির জন্ম হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে তারা বিদেশে বাড়ি তৈরি করছে। প্রতিবছর ৭৮ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। ক্ষমতাসীনরা পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। কৃষক, শ্রমিক আর মজুররা বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকেই চলেছে। গত ১৪ বছরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ক্ষমতাসীনরা সাধারণ জনগণের কথা বেমালুম ভুলে গেছে।
দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস হবার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশ ও দলে গণতন্ত্র চর্চার পরিবর্তে পরিবারতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলীয় পদে নমিনেশন পেতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেয়া লাগছে। টাকার বিনিময়ে পদে আসীন হয়ে নেতাজি টাকার নেশায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে। দ্রুত প্রদত্ত ঘুষের টাকা উসুল করতে বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। এসব নীতিহীন ব্যক্তিই আবার প্রতিদিন আমাদের সততার নসিহত করে চলেছে। তারাই আবার গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেজে গণতন্ত্রের ফেরি করে বেড়াচ্ছে! এতসব কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাস্তবিকই আমরা গণতন্ত্রের গাঁয়ে এক কালো ছায়া লেপটে দিয়েছি। আজ পর্যন্ত সেই কালো ছায়াকে কেউ মুছে দিতে পারিনি। সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষের এখন আর রাজনীতিকদের প্রতি ন্যূনতম কোনো আগ্রহ নেই। দেশে একজন রাজনীতিক মানেই অনৈতিক ক্ষমতাধর, রাজনৈতিক মাফিয়া ও পেশিশক্তির অধিকারী। রাজনীতি মানেই হলো চাপাবাজি, ধান্ধাবাজি ও ভোটচুরি। রাজনীতি মানেই হলো জোর-জালিয়াতি করে ক্ষমতায় যাওয়া। সাধারণ জনগণের সম্পদ লুটপাট করে বড় লোক হওয়া। এ কারণে সাধারণ জনগণ রাজনীতিকদের থেকে আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোটের ব্যাপারে তারা একবারেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা তাদের ভোট প্রয়োগ করা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। যেকোনো দেশে যখন এমন অবস্থা চলতে থাকে এবং স্থায়ী হয় তখন বুঝতে হবে, রাষ্ট্রটি লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
দুই বছরের করোনা মহামারি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। তদুপরি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ইউরোপের মতো বাংলাদেশকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধ অধিক দীর্ঘ হলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়বে। রাজনীতি ও অর্থনীতি তার গতিপথ হারিয়ে ফেলবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের বাণি উচ্চারিত হচ্ছে। ২০২৩ সাল যতো কাছে আসবে দেশের সামগ্রিক অস্থিরতা ততোই বৃদ্ধি পাবে। সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্যে সকল প্রকার রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার অবশ্য অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আবার রাজনীতির মাঠে ‘খেলা পাল্টা খেলা’র মতো অশোভন ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। অবশ্য দেশের রাজনীতিকদের মুখে এ জাতীয় ভাষা ব্যবহার নতুন নয়। তবে ২০২৩ সালের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, সকল পক্ষই তাদের শিষ্টাচারহীন বক্তব্য বৃদ্ধি করছে। ক্ষমতায় যেতে ও থাকতে একে অপরের বিরুদ্ধে কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য প্রদান শুরু করছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিগত প্রশ্নবিদ্ধ দুটি নির্বাচন সরকারের নৈতিক শক্তি হারিয়ে দিয়েছে। মুখে তাঁরা যতো কথাই বলুক, ভিতরে তারা অনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে তারা বহুমুখী চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতি গুরুত্বারোপ করছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশন হিমশিম খাচ্ছে। সকল দল নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের জন্য ভয়াবহ কঠিন অনুভূত হচ্ছে। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন উঠছে, দেশে অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে? সচেতন মহলের মধ্যে মারাত্মক শংকা বিরাজ করছে। দিনে দিনে নৈরাজ্য বেড়েই চলছে। মনুষত্ব বিকাশের সকল পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি সে দেশের যুবসমাজ। সেই যুবসমাজের চরিত্র গঠনের সকল উপাদান দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। বিপরীতে চরিত্র নষ্টের সকল উপাদান ক্রমাগত সাপ্লাই দেয়া হচ্ছে। যাবতীয় নেশাদ্রব্য তাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। হাত বাড়ালেই তারা ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা জাতীয় নেশাদ্রব্য বিনামূল্যেসংগ্রহ করছে। দেশে বর্তমানে ১৭ কোটি মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যাই প্রায় ৬ কোটি। তাদের জাতীয়ভাবে কোনো ধরনের মোটিভেশন দেয়া হচ্ছে না। তাদের নৈতিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। লেখাপড়ার নামে ছোটো ছোটো এসব শিশুর কাঁধে গাদাগাদা বই তুলে দেয়া হচ্ছে। সেই বইয়ের ভারে তারা নুইয়ে পড়ছে। তাদের শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ পাবার জন্য নানা কোচিংয়ে পাঠানো হচ্ছে। সনদনির্ভর এসব লেখাপড়া তাদের বেকারত্ব উপহার দিচ্ছে। এ বেকারত্ব তাদের ক্রমাগত হতাশা আর অধোগতির দিকে ধাবিত করছে।
আজ আমরা অস্থির রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার যাতাকলে নিষ্পেসিত হচ্ছি। যা আমাদের স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। এতসব অসঙ্গতির মাঝেও আমরা উন্নয়নের মিথ্যা ফানুসে গদগদ হচ্ছি। উন্নয়নের ভ্রান্তিবিলাসে আমরা গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। জনগণের মনের ভাষা বুঝেও না বুঝার ভান করছি। গায়ের জোরে তাদের নিরবে নিস্পেষণ করে চলছি। বিগত দুই দশকে আমরা রাজনীতিতে বুঝেশুনেই ভ্রান্তনীতি অবলম্বন করেছি। আর সে ভুলনীতির উপর আমরা এখনও অটল রয়েছি। অথচ, আমাদের মাঝে প্রকৃত ও ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকলে আমরা রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে একটি টেকসই নীতির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হতাম। সেটা আমরা পারিনি। দেশের দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থাকে আমরা বিদায় করেছি। গণতন্ত্রকে আষ্ঠে-পিষ্ঠে চেপে ধরে গোষ্ঠিতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছি।
২০২৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ও বিরোধীদলকে আপোসহীন থাকতে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের লক্ষ্যপানে পৌঁছতে তারা লাঠির শক্তি ব্যবহার করছে। এটা কোনো স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের চিত্র হতে পারে না। বিরোধীদল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। সরকার সে দাবি বরাবরই প্রত্যাখ্যাান করে আসছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার নিজেদের অধীনেই নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। একই কারণে বিগত দুটি নির্বাচনে বিনা ভোটেই সরকারি দলের লোকরা নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধীদল নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। রাষ্ট্র সম্পূর্ণ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ক্ষমতা একতরফা ও নিরঙ্কুশ হওয়ায় সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজ ও পেশার সকল স্তরে সহিংসতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশের যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রেও ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের প্রশাসনিক সকল প্রতিষ্ঠান অকেজো ও স্বেচ্ছাচারি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রশাসন নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণতন্ত্র ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে। মনে রাখাতে হবে, জনমনে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা তখনই ফিরে আসবে, যখন গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরে আসবে। ফিরে আসবে ন্যায়বিচার ও সুশাসন।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন