ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের আব্দুল হাইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্যে অসহায় হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতৃবৃন্দ। ২০০৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ পাওয়ার পর থেকেই তার নেতৃত্বে চলছে নানা অনিয়ম-লুটপাট, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ ত্রাসের রাজত্ব। দীর্ঘ ১৭ বছর একই পদে থাকার সুযোগে দলের নিবেদিত ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী অনুগত বাহিনী গড়ে তুলে সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব বলয়। তার কর্মকান্ডকে মেনে নিতে পারছেন না দলীয় নেতা কর্মীরা। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দফায় দফায় হামলা, নির্যাতন, ভূমি দখলসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। এর মাধ্যমে নিজ দলীয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একাত্তরের পাকহানাদার বাহিনীর কর্মকান্ডকেও হার মানিয়েছেন তিনি এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। দুর্নীতি, অনিয়ম, হত্যা-নির্যাতনে মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠায় তৃণমূল থেকে জারালো দাবি উঠেছে, জেলার শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তনের। অন্যথায় দলীয় বিশৃঙ্খলা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। পাশাপাশি বিরোধী শক্তিগুলো দিন দিন তাদের অবস্থান পোক্ত করবে। আর এতে আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি হতে পারে আওয়ামী লীগের। এমন বক্তব্যই বেরিয়ে এসেছে জেলা ও উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মুখ থেকে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও বর্তমান সহ সভাপতি আ্যড. আজিজুর রহমান বলেন, বর্তমান কমিটির অদক্ষতার কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তাদের অসহযোগিতা ও বিরোধিতার কারনে জেলা পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় ঘটেছে। যে দ্বায়ভার তাদেরই নিতে হবে। যে কারণে জেলার নেতা-কর্মীসহ সাধারন কর্মীরা তাদেরকে আর চাই না। তাদের দাবি নতুন নেতৃত্ব আসুক।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব আলী জোর্য়াদার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জেলা আওয়ামী লীগের প্রধান নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা তৃণমূল নেতা কর্মীদের আকাঙ্খা মেটাতে ব্যার্থ হয়েছেন যে কারণে তারা আর ওই নেতৃত্ব চাই না। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের সঠিক নেতৃত্বের জন্য চায় নতুন মুখ। তিনি আশা করেন আজ রোববার (১৩ মে) জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রধান পদগুলোতে নতুন নেতা তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উপহার দিবেন।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের এক নম্বর সদস্য অধ্যাপক আবেদ আলী বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের দূর্বলতার কারণে পৌরসভা এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে। আমরা চাইছি, আগামী ১৩ তারিখের নির্বাচনে নতুন নেতৃত্ব যেন আসে। বর্তমান জেলা কমিটির সভাপতি আব্দুল হাইয়ের কারণে আজকে জেলা আওয়ামী লীগের এই অবস্থা। আমরা চাচ্ছি নেতৃত্বের পরিবর্তন হোক। শৈলকূপা আওয়ামী লীগের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শৈলকূপার অবস্থাও ভালো না। যারা নেতৃত্বে আছে তাদের দিয়ে দল চালানো সম্ভব না। আমি একসময় শৈলকূপা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম, সেক্রেটারি ছিলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। আমাদের সময় সংগঠন শক্তিশালি ছিল। বর্তমানে গোটা জেলায় আব্দুল হাইয়ের জন্য দল দুর্বল। তার নেতৃত্ব দেওয়ার কোনো যোগ্যতা নাই। সে একজন ক্রিমিনাল টাইপের লোক। উনি সততার সঙ্গে দল চালান না। আমাদের জেলার বর্তমান এই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব।
শৈলকুপার সারুটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও শৈলকুপা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম জুলফিকার আলী কায়ছার টিপু বলেন, আব্দুল হাই এমপি সারুটিয়া ইউনিয়নে তার অনুসারী চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহামুদুল হাসান মামুনকে বিজয়ি করার জন্য যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, লুট-পাট নারী ধর্ষণসহ যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন এবং করে যাচ্ছেন সেটি ১৯৭১ সালের পাক বাহিনীর কর্মকান্ডকেউ হার মানিয়েছে।
এই নেতা আরো বলেন, আমাকে পরাজিত করতে তিনি গত ইউপি নির্বাচনের আগে কাতলাগাড়ী বাজারে এক জনসভায় হুংকার দিয়ে বলেছিলেন টিপু তোমাকে শায়েস্তা করতে শৈলকুপার সকল ইউনিয়ন থেকে মানুষ আনা হবে। তিনি বলেন, এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে আব্দুল হাই কতটা ভয়নক মানুষ। তিনি বলেন যে মুখোশধারী নেতা হায়নার থেকেও ভয়ংকর তাকে নেতা হিসাবে আর কেউ দেখতে চাইনা। তাই আগামী ১৩ নভেম্বর জেলা আ’লীগের সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব আনা হোক। তাহলে শৈলকুপাসহ জেলায় আওয়ামী লীগের সচ্ছ রাজনীতির মাঠ তৈরি হবে।
শৈলকুপা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার বলেন, ঝিনাইদহ-১ আসনের এমপি আব্দুল হাই শৈলকুপার রাজনীতিতে তিনি কোনো প্রতিপক্ষ রাখবেন না এমন মিশন নিয়ে তিনি আমার ৪ ভাইয়ের বিরুদ্ধে হাটের টেন্ডার ক্রয় করার অপরাধে মিথ্যা মামলা দেয় এবং তিন ভাইকে জেলে পাঠায়। ৫ মাস জেল খেটে বের হবার পর মেজো ভাই এই অপমান সহ্য না করতে পেরে হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান। এর সব কিছুর পেছনে ছিল এমপি আব্দুল হাইয়ের মসনদ পক্ত করার মিশন। এখানেই খানেই শেষ নয় এমন হাজারো উধাহারণ আছে শৈলকুপা উপজেলার আনাচে-কানাচে। তাই আজ আর বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ও আ.লীগের নিবেদিত নেতা-কর্মীরা এই মুখোশধারী নেতার নেতৃত্ব চাইনা। আজকের সম্মেলনের মাধ্যমে এই অপশক্তিকে হটিয়ে নতুন নেতা নির্বাচিত করা হোক বলে তিনি জানান।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রশীদ বলেন, দলের জেলা কমিটির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতার কারণে এরকম অবস্থা। দলে এখন কোন্দল। নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছি। তাই কোন্দল নিরসনে নতুন মুখ জরুরি একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন ভরসা।
এমতাবস্থায় নিবেদিত ও পরিক্ষিত নেতা কর্মীদের দলের প্রধানের কাছে জোর দাবি ব্যর্থ কমিটি বাদ দিয়ে জেলার রাজনীতিকে সচ্ছ ও উজ্জীবিত করতে নতুন নেতৃত্ব উপহার দিবেন দলের প্রধানের কাছে। তাদের একটিই স্লোগান বিরোধিতের সাথে আঁতাত নয়, দলবান্ধব নেতা চাই।
ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকার দলীয় প্রার্থী কনক কা›িত দাস গত ১৭ অক্টোবর মাত্র ১৫ ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে যারা ভোটার ছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন সরকার সমর্থক জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু তারপরও নৌকার প্রার্থীর হার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর এ কারণে আব্দুল হাই এমপির নিজ আসন শৈলকূপায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন-অর-রশিদ ১০৯ ভোট পেলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ভোট পান ৮৭টি। এই আসনেই দলীয় প্রার্থী অনেক পিছিয়ে পড়ায় হেরে যান। এছাড়া নির্বাচনের অল্প কিছু দিন আগে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা রাজু কনক কান্তি দাসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় রাজুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও পরবর্তীতে আব্দুল হাই এমপি সাথে একই মঞ্চে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়।
পরাজিত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক কনক কান্তি দাস বলেন, আমার বিপরীতে যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল সে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তার অনেক টাকা। আমাদের দলের অনেক নেতাকর্মী তার কাছ থেকে টাকা খেয়ে দলের বিরুদ্ধে কাজ করছে। আসলে দলীয় কোন্দলই এই পরাজয়ের মূল কারণ।
এদিকে শুধু জেলা পরিষদ নির্বাচনেই নয়, ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনেও হেরেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। দীর্ঘ ১১ বছর পর গত ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন। প্রায় ৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে নৌকা প্রতীকের ক্লীন ইমেজের প্রার্থী আব্দুল খালেক হন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এছাড়া সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জেলার ৬৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩৩টি ইউনিয়নের দখল নেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী এবং স্থানীয় পর্যায়ে কোন্দলসহ নানা কারণে বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার ঘটনা ঘটে। আর এসবের পেছনে জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যোগ্য প্রার্থী বাছাই, দলীয় অন্তঃকোন্দল নিরসনসহ নানা ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে টাকার বিনিময়ে প্রাথী মনোনয়ন ও বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লগের বিপক্ষে কাজ করার। দীর্ঘ ১৭ বছর একই ব্যক্তিকে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পদে রাখায় এই ব্যর্থতা বলে মনে করছেন তৃণমূলের অনেকেই। কারন হিসেবে তারা বলছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তার নিজস্ব বলয়ের উর্ধ্বে উঠতে পারেন না। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এতে করে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
এসব বিষয়ে জানতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন