জাতীয় নির্বাচনের এখনও প্রায় একবছর বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ডিসেম্বরে মাঠ দখলের লড়াইয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হবার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কথার লড়াই চলছে বৃহৎ দুটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সভা সমাবেশে ‘খেলা হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, খেলা হবে ভোট চুরির বিরুদ্ধে, খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, খেলা হবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। ভালো কথা, দেশবাসীও তো সেটাই চায়। মানুষও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চায়। তবে সরকার তাদের শাসনামলে দুর্নীতির লাগাম যে খুব একটা টেনে ধরতে পেরেছে তা কিন্তু বলা যায় না। বিএনপি তো দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে। তাহলে তিনি কার বিরুদ্ধে খেলতে চান। তিনি কি দেশের সম্পদ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে খলতে চান? দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে যারা বেগমপাড়া বা সেকেন্ড হোমে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কি তিনি খেলতে পারবেন? দেশবাসী আসলে সে বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা পেতে চায়। যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কি তিনি খেলতে পারবেন? ভোট চুরির বিরুদ্ধে কি সরকার সত্যি খেলতে চায়? এমন হাজারো প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। খেলা হোক সমস্যা নেই। তবে জনগণের প্রত্যাশা হলো, খেলা হোক দেশের পক্ষে, ক্ষমতায় থাকার বা ক্ষমতায় যাবার জন্য নয়। খেলা হোক মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্য। খেলা হোক দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
২০১৪ সালের মতো আরেকটি ভোটার বিহীন নির্বাচন হোক, দেশবাসী আসলে সেটা চায় না। ২০১৮ সালের মতো দিনের ভোট রাতে হোক সেটাও কেউ দেখতে চায় না। এদিকে বিএনপিও জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্য, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য, দুর্নীতি ও সুশাসনের জন্য বিভাগীয় শহরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে তাদের দাবির বিষয়ে জনমত তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? দাবি যেহেতু এক ও অভিন্ন তাহলে সমাবেশের দু’দিন আগে থেকে কেন গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়? কেন সমাবেশমুখী জনস্রোতকে বাধা দেয়া হয়? কেন তাদের ওপর হামলা মামলা করা হয়? কেন সমস্যা সমাধানে আলোচনা হয় না? বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা না দেবার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ময়মনসিংহ, রংপুর, খুলনা ও বরিশালে বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও তাতে সরকারি দল যে খুব লাভবান হয়েছে বা সমাবেশে জনসমাগম কম হয়েছে তা কিন্তু নয়। বরং আগে যেখানে একদিন সমাবেশ হতো, এখন তা তিনদিন ধরে হয়। আগে যেখানে গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ একদিনই সমাবেশের খবরাখবর পেতেন, এখন সেখানে দেশের গণমাধ্যম তিনদিন ধরে সংবাদ প্রচার করে। আগে যেখানে বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করতো আর সরকারি দল জনজীবন স্বাভাবিক রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যেত, এখন পরিবহন সমিতি ঘোষণা দিয়ে সমাবেশের একদিন আগে ও সমাবেশের দিন সকল প্রকার গণপরিবহন বন্ধ করে দিচ্ছে। বিকল্প মাধ্যমে বা নিজস্ব পরিবহনে যারা চলাচলের চেষ্টা করছে পথে পথে বাধা দিয়ে দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হলেও সরকার রহস্যজনকভাবে নিরবতা পালন করে থাকে। যা সাধারণ মানুষের মনে সরকারের বিরুদ্ধে বৈরিভাব সৃষ্টি করছে। তাই, এসব করে এ পর্যন্ত হওয়া বিভাগীয় বিভিন্ন শহরের সমাবেশগুলোতে লোকসমাগম কমানো যায়নি। বরং ভোগান্তি চরমে উঠায় প্রকাশ্যে সাধারণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এমন অসহিষ্ণু ও অগণতান্ত্রিক আচরণে মানুষ অতিষ্ঠ। গণতন্ত্রকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা হচ্ছে। সরকারি দল এবং তাদের অনুগত দল ছাড়া অন্যকোন রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড বিভিন্ন অযুহাতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। সরকার সমর্থকরা যখন খুশি, যেখানে খুশি সমাবেশ করতে পারলেও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি তা পারে না। সমাবেশের অনুমতি দেবার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চাহিদামত স্থানে সভা করতে দেয়া হয় না। যা সুশাসন ও উম্মুক্ত গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।
এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ফলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি আজ চরম সংকটে। রপ্তানি আয় নিম্নমুখী, রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি শ্লথ, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে বেশ খানিকটা টান পড়েছে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির হার গত ১১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কর জিডিপির হার বিশ্বে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বাজেটে অনৈতিকভাবে সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসেনি। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। আর্থিক খাতের অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা সংকটাপন্ন। তারল্য সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশি বিদেশি বিনিয়োগ মোটেই বাড়েনি। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর মধ্যে দেশে যে একেবারেই কোনো উন্নতি হয়নি তা কিন্তু নয়। দেশে বেশ কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য, কিন্তু প্রকল্প ব্যয় ও প্রকল্পের মেয়াদকাল দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব প্রকল্প ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের রপ্তাানিমুখী শিল্পকারখানায় উৎপাদনের গতি কমে গেছে। অন্যদিকে ভালো নেই দেশের কৃষক। কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রতিটি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সার, কীটনাশক ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাবার অভিযোগ রয়েছে। মজুদদার ও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সাধারণ ভোক্তারা জিম্মি। সুশাসনের বড়ই অভাব। দেশের অধিকাংশ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অতিমাত্রায় দলীয়করণের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত। চাইলেই সরকারি দল সভা সমাবেশ করতে পারলেও বিরোধী দলের সে সুযোগ অনেকাংশেই সীমিত। গণমাধ্যম চাপমুক্ত বলাটা খুব কঠিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন কমিশনের অতিকথন ও কিছুকিছু সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই ভোটাদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ তাদের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্বাধীনতার মূল চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে গণতন্ত্রের নিরপেক্ষ চর্চা ফিরিয়ে আনা জরুরি। উন্নয়নের গণতন্ত্র তত্ত্বের নামে মানুষের ভোটাধিকার হরণের রাজনীতি নয়, বরং মুক্ত পরিবেশে, সবার অংশগ্রহণে মানুষের ভোট ও বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই হোক আগামীর রাজনীতি। দেশবাসী সেটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন