নভেম্বর মাস হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সার সচেতনতা মাস ২০২২। ফুসফুসকে সুস্থ রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর কারণ হলো, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার অন্যতম অঙ্গ এই ফুসফুস। বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই নভেম্বর মাসটিকে ফুসফুসের ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসাবে পালন করা হয়। আমাদের দেশেও সেমিনার ও সিমপোজিয়ামের মাধ্যমে এই মাসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়ে থাকে।
এটি প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ অন্যান্য ক্যানসার শনাক্তকরণে যে স্ক্রিনিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা ফুসফুস ক্যানসারের ক্ষেত্রে ততটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে না। তাই আর্লি স্টেজ পার হলে কিংবা ইন্সিডেন্টাল ফাইন্ডিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। যেমন অনেক সময় দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কারণে ফুসফুসের এক্সরে করেছেন, সেখান থেকে সন্দেহজনকভাবে পরবর্তী সময়ে ফুসফুস ক্যানসার শনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুঝুঁকির প্রসঙ্গ আসলে বলতে হবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্যানসারে মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
ফুসফুস ক্যানসার দুভাবে হতে পারে। এক. ফুসফুসে ক্যানসার যখন শুধু ফুসফুসেই সীমাবদ্ধ থাকে। বলা যায় কাশি, জ্বর, গলার স্বর পরিবর্তন, কাশির সঙ্গে রক্ত কিংবা শ্বাসকষ্ট ফুসফুসে ক্যানসারের কিছু সাধারণ উপসর্গ, যেগুলো ফুসফুসে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে।
দুই. ফুসফুস ক্যানসার ফুসফুসে সীমাবদ্ধ না থেকে ফুসফুস থেকে অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে; যেমন হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে প্রবল ব্যথা অনুভব হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুস ক্যানসার মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে যেতে পারে। এটি লিভারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এ ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা কিংবা জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোগটি কোন স্তরে আছে সেটির ওপর নির্ভর করেই চিকিৎসা প্রদান করা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে ফুসফুস ছাড়িয়ে এটি অন্য কোথাও এমনভাবে চলে যায় যে সেসব অঙ্গে ক্ষতির লক্ষণ নিয়ে যখন রোগী পরামর্শ নিতে আসে, তখন ফুসফুস ক্যানসার ধরা পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৫%-৯০% ফুসফুসে ক্যানসারের জন্য দায়ী হলো ধূমপান। এ ছাড়া পারিবারিক সূত্রে কিংবা বার্ধক্যজনিত অন্যান্য রোগের কারণেও অনেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। তাই ফুসফুসে ক্যানসারের উপসর্গ দেখামাত্রই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
> ক্যান্সার কী?
বহুকোষী প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের সমন্বয়ে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মৃত্যুবরণ করে। আর এই পুরনো মৃত কোষগুলোর স্থানে নতুন তৈরি হওয়া কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমাফিক বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। তবে যখন এই কোষগুলো ক্যান্সার সহায়ক অনকোজিন সক্রিয় হওয়ার কারণে অথবা ক্যান্সার দমনকারী জিন নিষ্ক্রিয় থাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতেই থাকে; তখনই সেই স্থানে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। যাকে বলা হয় টিউমার। এই টিউমার বিনাইন কিংবা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই ক্যান্সার নামে পরিচিত। অর্থাৎ নিওপ্লাস্টিক বা টিউমার কোষ উচ্চহার বিশিষ্ট আক্রমণাত্মকতা, মেটাস্টাসিস এবং শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার বলে অভিহিত করা হয়।
> ফুসফুসের ক্যান্সারঃ-
উপরোক্ত বিষয়গুলো ফুসফুসে সংঘটিত হলে তাকে বলা হয় ফুসফুসীয় ক্যান্সার। শ্বাসতন্ত্রের যাবতীয় রোগের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার সবচেয়ে মারাত্মক। আমাদের দেশে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঠিক পরিসংখ্যান তেমন নেই। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর মারা যান প্রায় ৯১ হাজার ব্যক্তি। মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিগণ প্রধানত ফুসফুস, কোলোরেক্টাল, পাকস্থলি, লিভার, স্তন, খাদ্যনালী, প্যানক্রিয়াস ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারে ভুগেই মারা যান সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শনাক্ত মোট ক্যান্সার রোগীর প্রায় ১৬ শতাংশই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার শুধু ফুসফুসেই সীমাবদ্ধ না থেকে তা লসিকাগ্রন্থি ও অন্যান্য অঙ্গে (যেমন মস্তিষ্ক, হাড় ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়তে পারে।
> ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণঃ গ্রামের চেয়ে শহরে যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, বায়ুদূষণ, ধুলাবালি সবকিছুই অনেক বেশি। অজৈব পদার্থের ক্ষুদ্র কণা বা আঁশ যেমন- এসবেস্টস, নিকেল, ক্রোমিয়াম এবং জৈব পদার্থ যেমন- বেনজিন, বেনজোপাইরিন ইত্যাদি বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ফুসফুসের ওপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারই এর জন্য দায়ী। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপায়ী ও তামাকসেবী।
আবার ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর আত্মীয়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও অন্যদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া সিলিকোসিস, ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ক্রোনিক ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগগুলোতে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেশ বৃদ্ধি পায়।
বায়ুতে রেডন গ্যাসের উপস্থিতি এবং অনাকাঙ্ক্ষিত তেজস্ক্রিয়তাও ফুসফুসের ক্যান্সারের উল্লেখযোগ্য কারণ। কতিপয় বিশেষ পেশাজীবী, যেমন- কয়লার খনিশ্রমিক, বিল্ডিং নির্মাণ শ্রমিক, পেট্রোলিয়াম, কেমিক্যাল বা রাবার কারখানার শ্রমিক ও জাহাজ শ্রমিক, যারা এক্স-রে বিভাগে কাজ করেন, যাদের রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়, অ্যাসবেস্টস কারখানার কর্মী কিংবা প্রচুর ধূলা-বালুর মধ্যে কাজ করেন- এ ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার হার বেশি। সেইসঙ্গে শরীরের অন্য কোথাও ক্যান্সার হলে সেই স্থান থেকে রক্তের মাধ্যমে দ্রæত ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকে। প্রায় ৪০ শতাংশ রোগীর ফুসফুসের ক্যান্সার একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে। এর কারণ হলো অবহেলা।
> ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণঃ
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো কাশি। কাশি যদি আট সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় সঙ্গে বুকে ব্যথা থাকে তাহলে সাবধান হতে হবে। দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাশি দেখা যায়। কাশির সঙ্গে কফ তৈরি হবে বা খুশখুশে কাশিও হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ। কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠা ফুসফুস ক্যান্সারের আরেকটি লক্ষণ। এ ছাড়াও ক্যান্সার কোষ শ্বাসনালির কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্টও।
তদুপরি দীর্ঘদিন গায়ে গায়ে জ্বর থাকা, হঠাৎ করে ডায়েট বাবা ব্যায়াম ছাড়াই প্রায় ৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমে যাওয়া, ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কর্কশ বা খসখসে হয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর বা কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পরিবর্তন, দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্লান্তি বা অবসাদবোধ, দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতিও হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ।
পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন ঘাড়, পিঠ, বুক ও বাহুতে ব্যথা হতে পারে। যা কাশি দেওয়ার সময় আরো বেড়ে যায়। প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের ফুসফুস ক্যান্সার ধরা পড়ে বুক ও কাঁধের ব্যথা নির্ণয়ের মাধ্যমে।
> ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তকরণঃ-
ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বুকে এক্স-রে করা হয়। মাইক্রোস্কোপের নিচে কফ বিশ্লেষণের মাধ্যমেও অনেক সময় ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। তবে ক্যান্সার শনাক্তের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো বায়োপসি। যেখানে অস্বাভাবিক কোষ বা টিস্যুর পর্যবেক্ষণ বা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। প্রচলিত বায়োপসিগুলোর মধ্যে ব্রংকোস্কপি, মেডিয়াস্টিনোস্কপি, নিডল বায়োপসি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ফুসফুসীয় ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করার আগে ক্যান্সার কোন পর্যায়ে আছে- তা নির্ণয় করা হয়। ক্যান্সারের ধরণ, অবস্থান ও আকার, স্টেজিং, গ্রেডিং এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়।
> পরামর্শঃ ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধূমপান না করা ও তামক সেবন থেকে বিরত থাকা। এমনকি ধূমপায়ীর নিকটে অবস্থান করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। শিল্প কারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া নির্গমন গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা জরুরি। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন- ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি এড়িয়ে চলাও বুদ্ধিমানের কাজ। আবার ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ যেমন- য²া, নিউমোনিয়া ভালো হয়ে যাওয়ার পর ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে যথাসম্ভব সতর্ক থাকা আবশ্যক। ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি যদি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন ২০টির বেশি সিগারেট ব্যবহার করেন; তাহলে তাদের ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং করা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। ফুসফুসের নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিজের হাতে।
প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
মোবাইল: ০১৮২২-৮৬৯৩৮৯
ইমেইল: drmazed689@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন