রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ফসলের মাঠ সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। অগ্রহায়ণের হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে সরিষার ফুল। যেদিকে তাকাই শুধুই হলুদের সমারোহ। সরিষা ফুলের রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত যেমন মাঠ, তেমনি বাম্পার ফলনের আশায় কৃষকেরা।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে শীত বাড়ার সাথে সাথে এসব সরিষা ক্ষেতে দেখা দেয় ফুল। আর তা ওপর থেকে দেখলে মনে হবে যেন হলুদ গালিচা বিছানো। ভ্রমর মধু খুঁজে ফিরছে সরিষার ফুলে ফুলে। মধুমাখা ক্ষণে, প্রকৃতির সনে, সুবাসে মশগুল, সরষে ফুল। বিকেল বেলাতে, মৌমাছির খেলাতে, গুনগুন তোলে রব, চারিদিকে সৌরভ, কবির লেখা কবিতার মতোই অসাধারণ এ চিত্রপট ফুটে উঠেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বরেন্দ্রাঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠে। দৃষ্টিনন্দন এমন পরিবেশকে ক্যামেরা ফ্রেমে বন্দি করতে ব্যস্ত দর্শনার্থীরা।
কৃষকরা আগে এসব জমিতে শুধু ইরি-বোরো এক ফসল আবাদ করে হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত ফেলে রাখতেন। কালের বিবর্তনে এ অঞ্চলের কৃষকদেরও কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে। তারা বিগত দু’যুগ ধরে ইরি-বোরো, আমন, টমেটো করোলা. লাউ, পটল, শীম, ভুট্টা, তরমুজ আবাদের পাশাপাশি সরিষায় ঝুঁকেছেন।
এ বছর গোদাগাড়ীতে বাম্পার সরিষার ফলন আশা করছেন কৃষক। কৃষি অফিসের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করছেন। গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় চলতি মৌসুমে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ২শ’ ৪০ হেক্টর। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলায় গত বছর ৭ হাজার ২১০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল। বারি সরিষা-১৪ জাত ২ হাজার ৮শ’ ৪৫ হেক্টর, বারি সরিষা-১৫ জাত ২ হাজার ৬শ’ ৯০ হেক্টর, বারি সরিষা-১৭ জাত ২শ’ ৩৫ হেক্টর, এছাড়া বিনা সরিষাসহ স্থানীয় কিছু জাত চাষ হয়েছে।
সরিষা ক্ষেত থেকে বাড়তি আয় করতে অনেক বেকার যুবক এবং কৃষক মৌবাক্স স্থাপন করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর গোদাগাড়ী সকল ধরনের কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে। কিছু কিছু জমিতে মধু আহরণের জন্য চাষীরা মধু সংগ্রহের বাক্স বসিয়েছেন।
সরিষা প্রধানত আবাদ হয় দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটিতে, বিশেষ করে নদী বিধৌত এলাকায়। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে দু-একটি চাষ বা বিনা চাষেই জমিতে ছিটিয়ে সরিষা বীজ বপন করা হয়। সরিষা চাষে সেচ ও সার লাগে কম। সরিষার পাতা একটি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। তেল নেয়ার পর অবশিষ্ট অংশ গরুর খৈল হিসেবে খাওয়ানো হয়। এতে প্রচুর পুষ্টি থাকে। জ্বালানি হিসেবে সরিষার গাছ ব্যবহার করা হয়। তেল বীজ, মধুর পাশাপাশি কৃষকরা সরিষা থেকে উন্নত গো-খাদ্যও তৈরি করতে পারবে বলে আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার বিলপাতিকলা, দুর্গাদহ বিল, রেলগেট বিল, সুশাডাং, বোগদামারি, কালিদীঘি, পিরিজপুর, প্রেমতলী, সিধনা বিল, গ্রোগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিস্তীর্ণ মাঠ সরিষার হলুদে ফুলে ছেয়ে গেছে।
গোদাগাড়ী এলাকার কৃষকরা জানান, কালের প্রেক্ষাপটে আমন ধানের বিকল্প হিসেবে গোদাগাড়ীতে তারা বোরো ধান চাষে ঝুঁকে পড়েন। বিল চাড়ায়ের পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে মাঠের কৃষক কখনো সরিষার আবাদ করার কথা ভাবেনি। এখন থেকে ২০ বছর আগে এ বিলের কৃষক সমাজ ভাবতে পারেনি এ জমিতে সরিষা, মশুরি চাষ সম্ভব। গত কয়েক বছর বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় এ বিলের মাঠে মাঠে সরিষার আবাদ চলছে পুরোদমে।
গোদাগাড়ী পৌর এলাকার কৃষক আব্দুল মতিন জানান, এ বছর আমি ৩ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ৭ মণ হারে সরিষার ফলন হবে। একই গ্রামের শামসুল আলম জানান, সরিষার আবাদের পরই জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা যায়। এতে জমিতে সার কম লাগে। অল্প সময়ের মধ্যে ২টি ফসল ঘরে তুলতে পারছে কৃষক।
ভাজনপুর এলাকার কৃষক দুলু দেব বলেন, বর্তমানে মাঠে সরিষা, ভুট্টা, বিনাচাষে রসুন, ধনিয়া, গমের আবাদ হয়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার অন্টু সরকার ইনকিলাবকে জানান, সোয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে তেলের চাহিদা মেটাতে কৃষকদের সরিষা চাষে সচেতন করা হচ্ছে। তৈল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় মোট ১ হাজার ৬শ’ ৫০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার প্রদান করেছে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার কৃষি হবে দূর্বার’।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা ইনকিলাবকে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃষককে একের অধিক ফসল ফলানোর জন্য নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া উপসহকারী কৃষি অফিসারগণ সার্বক্ষণিক মাঠে কৃষকদের সাথে কাজ করছেন। যাতে কৃষকদের কোনো প্রকার সমস্যার সৃষ্টি না হয়। আশা করছি, প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটলে এবার বিল চড়াইসহ গোদাগাড়ী সরিষা, গম, পেঁয়াজ, রসুনের বাম্পার ফলন হবে। সাধের ফসল ঘরে তোলায় আশায় স্থানীয় কৃষকদের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন