ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। ম্পর্শকাতর এলাকা থেকে দিনেদুপুরে এভাবে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর দায় খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে দেশের আদালত ও কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। দাগী আসামিদের আদালতে আনা-নেয়ার বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া যেত কি না-এ নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ঢিলেমি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও। জঙ্গিদের কোমরে রশি, হাতে হ্যান্ডকাফ থাকলেও ঘটনার সময় ছিল না কোনও ডাণ্ডাবেড়ি। জেলকোড অনুযায়ী, দুর্ধর্ষ বন্দিদের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে নেয়ার সময় নিরাপত্তার জন্য পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়। সেটা এখনও বলবৎ রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা কোন ভিডিও ফুটেজ না থাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় কেন সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল না। আদালতপাড়া সব সময় যানজটের মধ্যে থাকলেও ঘটনার সময় রাস্তা ফাঁকা থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। অপরদিকে ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এছাড়া পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপি কর্তৃপক্ষের গঠিত দু’টি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ছিনতাইকৃত দুই জঙ্গীকে গ্রেফতারে কাজ করছে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক ঠিম ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, আদালত থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা তিন মাস আগের। কাশিমপুর কারাগারে বসেই এই পরিকল্পনা চলে। প্রথমে প্রিজন ভ্যানে হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। দীর্ঘদিন রেকি শেষে পরিস্থিতি তুলনামূলক সহজ হওয়ায় আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা করা হয়।
ডিএমপির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় গত রোববার ডিএমপি কমিশনার স্বাক্ষরিত এক আদেশে ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ৩ কার্যদিবসের মধ্যে ডিএমপি কমিশনারের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আজ বুধবার নির্ধারিত তিন কার্যদিবস শেষ হচ্ছে। এর আগেই গতকাল মঙ্গলবার তদন্তের জন্য আরো সাত কার্যদিতবস সময় চেয়ে ডিএমপি কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রদান হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) একেএম হাফিজ আক্তার। বাকি চার সদস্য হলেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন), যুগ্ম কমিশনার (সিটিটিসি), ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ও ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সিআরও)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল তদন্ত কমিটির সভাপতি ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, তদন্ত শেষ করতে আরও সময় লাগবে। আমরা সব ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছি। প্রাপ্ত ডকুমেন্টগুলো নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। এই মূহুর্তে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি সদস্যকে ছিনতাই অপরারেশনে নেতৃত্বদানকারীর নাম-পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এই অপারেশনে তাদের বেশকয়েকজন সহযোগীকেও শনাক্ত করা হয়েছে। জঙ্গি ছিনতাই অপারেশনে নেতৃত্বদানকারীসহ সবাইকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমরা কাজ করছি।
প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন জানান, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চাঞ্চল্যকর, সাজাপ্রাপ্ত বা একাধিক মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আদালতে হাজির করার সময় ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়ে কারা সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, কোর্টে হাজিরার সময় গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের ডান্ডাবেড়ি না পরানোর কারণে এরই মধ্যে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ডান্ডাবেড়ি পরানো থাকলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতো। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কারা সদরদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এদিকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করে আদেশ জারি করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নন), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
সূত্র জানায়, কারাগার বরাবরই জঙ্গিদের যোগাযোগ ও পরিকল্পনার জন্য ‘নিরাপদ স্থান’ হয়ে উঠেছে। তারা সেখানে টাকা দিয়ে নিয়মিত সংগঠনের বাইরে থাকা সদস্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখছেন এবং নানা পরিকল্পনা করেছেন। এসব বিষয়ে নানা সময় কারা কর্তৃপক্ষকে বার বার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলেও উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে কারাগারের এমন অবস্থা যে, টাকা দিলেই জঙ্গি সদস্যরা সারারাত নিজেদের সেলে ফোন ব্যবহার করতে পারছেন। সেখানে বসেই তাদের যাবতীয় পরিকল্পনা হয়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা।
গত ২০ নভেম্বর রোববার দুপুর ১২টার দিকে একটি মামলায় ১২ জঙ্গিকে আদালতে হাজির করা হয়। হাজিরা শেষে পুলিশ সদস্যরা তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে করে জঙ্গি সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এই দুই জঙ্গি দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাদের আইনের আওতায় আনতে এরই মধ্যে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছে পুলিশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন