সুনামগঞ্জের ছাতক ও সিলেটের ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত রোপওয়ের ১৯ কিলোমিটার রজ্জুপথ, ছাতক-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচলসহ বন্ধ রয়েছে কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট। এসব স্থাপনাগুলো ছাতকের ঐতিহ্য বহন করে আসছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এবং কিছু দূর্নীতিবাজদের কালো থাবায় এক এক করে আজ এসব সরকারি স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এগুলো বন্ধ থাকায় সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছে ধস। এখানের রেল বিভাগ আর আলোর মুখ দেখবে কিনা এমনটাই প্রশ্ন এ অঞ্চলের মানুষের।
জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের অধিনস্থ ছাতক-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচল, দেশের একমাত্র রোপওয়ে (রজ্জুপথ) ও কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট বন্ধ রয়েছে। স্থাপনাগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় এবং পূনরায় চালু না হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় দিন কাটছে। এতে হারাতে বসেছে ছাতকের ঐতিহ্য।
পাথর আনার জন্য ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের ১৯কিলোমিটার রজ্জুপথ স্থাপন হয়েছিল ১৯৬৪-১৯৭০ সালে। দীর্ঘ ৬ বছরে নির্মিত হয় এ রোপওয়ের রজ্জুপথ। এটি স্থাপন হওয়ার এক বছরের মাথায় শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। তখন উৎপাদনে যেতে পারেনি এ প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার যুদ্ধে রোপওয়ের রজ্জুপথ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ক্ষতিগ্রস্থ রোপওয়ের রজ্জুপথ মেরামতের পর চালু হয়েছিল। রোপওয়ের ভোলাগঞ্জস্থ নিজস্ব জায়গা থেকে পাথর তুলে রজ্জুপথে ছাতক স্টেশনে আনলোডিং করা হতো। আর এ পাথরগুলো সারা দেশের রেললাইনের নিচে দেয়া হতো। এ ভাবে চলে আসছিল দীর্ঘদিন। রোপওয়ের রজ্জুপথে ছিল ৪টি স্টেশন। পাথর পরিবহনে বাকেট (বাক্স) ছিল ৪২৫টি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাকেট চালু ছিল ২৪৬টি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর এ্যাঙ্গেল-১ স্টেশন থেকে সর্বশেষ ছাতকে পাথর আনা হয়েছিল। এর পর থেকে রোপওয়ের রজ্জুপথটি বন্ধ হয়ে পড়ে। প্রায় ৯ বছর ধরে আজও বন্ধ রয়েছে সরকারী এ প্রতিষ্ঠান। আর চালু হবে কিনা এ বিষয় অজানা রয়ে গেছে। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ রোপওয়ের রজ্জুপথ। স্প্যান, তার, ট্রেসেল ও বাকেটসহ মূল্যবান মালামাল প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে। অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এসব যন্ত্রাংশ চোরেরা লুটপাট করে খাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, সুনামগঞ্জের ছাতক ও সিলেটের ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত দেশের একমাত্র রেলওয়ের রোপওয়ের রজ্জুপথের ভোলাগঞ্জের নিজস্ব পাথর কোয়ারি থেকে কয়েক কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা কর্মচারিদের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন করে নিয়েছে প্রভাবশালী পাথর খেকোরা। পাথর উত্তোলন করায় সেখানের রোপওয়ে রজ্জুপথের একাধিক ট্রেসেল (খুঁটি) হেলে পড়েছে। এছাড়া রজ্জুপথের তার ছিড়ে হাওরের জমি, খালে ও নদীসহ বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে পাথর পরিবহনের বাকেট (বাক্স)। অনেকগুলো বাকেট ও ট্রেসেলের অংশ কেটে চোরেরা নিয়ে বিক্রি করছে।
এদিকে, ১৯৮৮ সালে ৬ একর জায়গা নিয়ে ছাতক রেলওয়ে স্টেশনের পাশে নির্মিত হয় কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট। কাঁচামালসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটিও বছরের প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকার অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের ১৬ মার্চ থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে কংক্রিট স্লিপার এ প্লান্টি।
অপরদিকে, ১৯৫৪ সালে স্থাপিত ছাতক-সিলেট ৩৪ কিলোমিটার রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ২০২০ সালের ২৩ মার্চ করোনা মহামারির কারণে সারা দেশের সাথে এখানেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। করোনা মহামারি কাটিয়ে দেশের সব অঞ্চলে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও ছাতক-সিলেট রেলপথে আজও ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। বন্ধ রেল লাইনে হরিলুট চলছে। স্টেশন কোয়ার্টারগুলিতে জুয়া, মদ-গাঁজার আসর বসছে প্রতিদিন। অপরাধিরা তাদের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেঁচে নিয়েছে। সেই সাথে রেললাইনের পাথর, স্লিপার, গাছ-গাছালি লুট হচ্ছে। জায়গা দখল করে দোকান কোঠা নির্মিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এই সবের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাড়াও রয়েছেন এলাকার প্রভাবশালী লোক। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভয়াবহ বন্যায় বন্ধ ওই রেলপথের অনেকাংশে ক্ষতি হয়েছে। এই যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
ছাতকবাজার রেলওয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা যায়, এ কার্যালয়ের অধিনে মঞ্জুরি পদ ছিল ১৪১টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ২৮জন। এর মধ্যে দুইজন চলতি বছরে অবসরে যাবেন। এখানের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত) দায়িত্বে আছেন সিরাজ জিন্নাত। তার মূল দায়িত্ব বিভাগীয় প্রকৌশলী ঢাকা-২। ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে ও পাথর কোয়ারির ভূমি রয়েছে ১০২৮.৩৩ একর। এর মধ্যে রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমি ৩৫৯.৮৭ ও খাস ভূমি রয়েছে ৬৬৭.৪৬ একর।
পাথর সঙ্কটসহ বিভিন্ন কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট ও ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল থেকে দেশের একমাত্র রোপওয়ের রজ্জুপথ বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্রগ্রাম-(পূর্ব) এর প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়ার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইনকিলাবের এ প্রতিবেদককে বলেন, রোপওয়ে রজ্জুপথ ধরে যেখান থেকে ছাতকে পাথর আনা হতো সেখানে আগের মতো পাথর আর নেই। এছাড়া এই রোপওয়ে রজ্জুপথটি চালু করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। তাই এ বিষয়ে আপাতত কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছেনা। একাধিক ট্রেসেল হেলে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, মাত্র দুই একটা হবে। তাও তুলা হয়েছে। এছাড়া বন্ধ রোপওয়েতে নিরাপত্তাকর্মীও রয়েছে। তিনি বলেন, কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট শিগগিরিই চালু করা হবে। ক্ষতিগ্রস্থ ছাতক-সিলেট রেলপথ মেরামত করে অবশ্যই চালু হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন