রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পরিযায়ী পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে পাখির প্রতি যতœশীল হওয়া ও দায়িত্বশীল আচরণ করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে অন্যান্য জীবের প্রতি আমাদের আচরণও সেরা হওয়া উচিত। অথচ, প্রতিনিয়ত কারণে-অকারণে আমাদের রূঢ় আচরণ ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয় নির্বাক পশু-পাখি। বিশেষ করে, প্রতিবছর শীতকালে আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষ পাখি শিকারে তৎপর হয়ে ওঠে, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ। বাংলাদেশে প্রতিবছর শীতের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে উড়ে আসে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। বিশেষ করে, উত্তর গোলার্ধে যখন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেক নিচে নেমে যায়, তখন সেখানকার পাখিদের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। শীতের মৌসুমে তাই বাসস্থান ও খাদ্যের জন্য ওইসব দেশ থেকে তারা দল বেঁধে ছুটে আসে অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডার দেশে। সাইবেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের মালভ‚মি, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড ও তিব্বত উপত্যকা থেকে এসব পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশের মতো কম ঠান্ডাপ্রবণ দেশে আসে। আমাদের দেশে যেসমস্ত পাখি আসে এদের মধ্যে থাকে বালিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি ও মানিকজোড়া অন্যতম। এখন দেশে শীতের শুরু, কুয়াশার হিমেল আমেজ জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। তার সাথে আনাগোনা দেখা যাচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, জলাশয় ও বন-জঙ্গল মুখরিত হয়ে উঠছে এসব পরিযায়ী পাখিদের কূজনে। ঢাকার পিলখানা, মিরপুর চিড়িয়াখানা ও মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পার্শ¦বর্তী লেক, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের হাওর, নদী, মৌলভী বাজারের বাইক্কা বিল, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ও রোয়া বিল, বৃহত্তর বরিশালের দুর্গাসাগর, ভোলার মনপুরা দ্বীপ, সুন্দরবনের দক্ষিণ উপক‚ল চরমানিক, পটুয়াখালীর পর্যটন স্থান কুয়াকাটা, খেপুপাড়া, সোনার চর, উত্তরের জেলা নীলফামারীর নীলসাগর, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের বিস্তৃত চলনবিল, পঞ্চগড়ের ভিতরগড় ও পদ্মার চর, নেত্রকোণার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জের নিকলি ও কলাদিয়া হাওরে দেখতে পাওয়া যায় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সন্দীপ, উড়ির চর, চরণদ্বীপ, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, চর ওসমান, বয়রা চর, চরভাটা, পর্যটন নগরী কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ ও হোয়াইক্যং ভরে উঠে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখিতে।

পাখি বিশ্ব প্রকৃতির এক অনন্য সম্পদ। এদের অবাধ বিচরণ ও প্রজননের ব্যাপারে সকলের যতœশীল হওয়া উচিত। বিশেষ করে, হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসা এসব অতিথি পাখিদের কোনো অবস্থায় মারা উচিত নয়, বরং তাদের যেন উপযুক্ত আবাস ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা যায় সে ব্যাপারে সরকার, প্রকৃতিসেবী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণের মুখ্য ভ‚মিকা থাকা দরকার। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পরিযায়ী পাখিদের অবাধ বিচরণের জন্য ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণ কোনো অভয়ারণ্য গড়ে তোলা আজও সম্ভব হয়নি। উল্টোদিকে দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন বিল-ঝিল, জলাশয় ভরাট করে বসতি স্থাপনের ফলে, বন-জঙ্গল উজাড় করে প্রতিনিয়ত পাখির আবাসস্থল ধ্বংস করার কারণে এবং প্রকৃতির বিরূপ আচরণে পাখিদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তার উপর কিছু মানুষ পাখি শিকার করার কাজে ব্যস্ত থাকে। অথচ, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী, অতিথি পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোাচ্চ এক বছরের কারাদÐ অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদÐ অথবা উভয় দÐে দÐিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহাংশ সংগ্রহ করে, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করে বা পরিবহন করে, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদÐ এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদÐ অথবা উভয় দÐে দÐিত হওয়ার আইন রয়েছে। এই আইন থাকার পরেও শিকার হয় পরিযায়ী পাখি। জালের ফাঁদ পেতে, বিষটোপ অথবা এয়ারগানের মাধ্যমে পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করে কিছু লোভী মানুষ। অনেকেই আছে আবার শখের বশেও পরিযায়ী পাখি শিকার করে রসনা বিলাস করে। তাছাড়া পর্যটকদের অবাধ আনাগোনা ও পাখিদের উত্যক্ত করার কারণে পরিযায়ী পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। তাই পরিযায়ী পাখির অবাধ বিচরণ ও নিরাপত্তার স্বার্থে দেশে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এসব অতিথি পাখির অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশ। দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে পাখিদের বেঁচে থাকা এবং বংশবৃদ্ধি করা। এমতাবস্থায়, আমাদের উচিত পাখির নতুন নতুন অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে তাদের অবাধ বিচরণ ও নিরাপদ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে পাখির জন্য নতুন নতুন আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি অতিথি পাখিদের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারি তাহলে প্রতিবছর পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং বিরল জাতের অনেক পাখি আমাদের দেশে থেকেও যাবে এবং বংশ বৃদ্ধি করবে। অহেতুক পাখি নিধন শুধু দেশীয় আইনেই নিষিদ্ধ নয়, বরং ইসলামেও নিষিদ্ধ। ইসলাম মানবাধিকাররের কথা যেমন কঠোরভাবে বলেছে, তেমনি করে জীবজগত ও পশু-পাখিদের ব্যাপারেও যথেষ্ট তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরান শরীফে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন: ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে, আর যত পাখি দুই ডানা মেল উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো এক একটি জাতি।’ (সূরা আনআম, আয়াত-৩৮) তাই পাখির ব্যাপারে যতœবান হওয়া আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। বিনা কারণে পাখি নিধন তো দূরের কথা, তাদের অঙ্গহানি করাও ইসলামে নিষেধ। হয়রত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গহানি করে।’ (বুখারি শরীফ) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের শিক্ষা মতে, যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো পশু-পাখি হত্যা করে, কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পশু-পাখি আল্লাহর দরবারে নালিশ করবে। পবিত্র কোরানের অনেক স্থানে পাখির কথা বলা হয়েছে, যাতে করে মানুষ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। তারপরও মানুষ বিভিন্ন নির্বাক প্রাণী ও পশু-পাখির প্রতি নির্দয় আচরণ করে, যা সত্যিই নিন্দনীয় ও পাপ কাজ। মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে ১৭শ শতক থেকে আজ পর্যন্ত ১২০ থেকে ১৩০টি প্রজাতির পাখি পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমাদের উচিত পরিযায়ী পাখির ব্যাপারে আরো দায়িত্বশীল আচরণ করা। জলাভ‚মিগুলোকে পরিচর্যা করে আরো ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি, যাতে করে পরিযায়ী পাখিদের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যেসব হাওর, জলাশয় কিংবা চরে পরিযায়ী পাখির আধিক্য দেখা যায়, সেখানকার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মনুষ্যসৃষ্ট সকল প্রতিবন্ধকতা নিরসনের ব্যবস্থা নিতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, পাখি শিকারী, উৎসুক জনতা বা পর্যটকদের আনাগোনায় যাতে পাখির অবাধ বিচরণে বিঘœ না ঘটে সেদিকে জোরালো দৃষ্টি দিতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে করে পরিযায়ী পাখি নিধনের মতো কাজ কেউ না করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তার নাগরিক দায়িত্ব পালন করে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব থেকে

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
জেসমিন সুলতানা চৌধুরী ২৪ নভেম্বর, ২০২২, ১১:৫৯ এএম says : 0
মাশাআল্লাহ সুন্দর এবং পরিপাটি লেখা
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন