শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিক্ষাব্যয় কমাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আন্তজার্তিক মানবাধিকারের ঘোষণার ২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পৌছে দেয়ার কার্যক্রম সক্রিয় থাকলেও শিক্ষার মান ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। মানবাধিকারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, কারিগরী ও পেশাগত শিক্ষা সর্বসাধারণের জন্য সুলভ হবে এবং উচ্চশিক্ষা হবে বৈষম্যহীন, মেধার ভিত্তিতে। বিশ্বের বহুদেশ মানবাধিকারের এই ঘোষণা বাস্তবায়ণের মধ্য দিয়ে সার্বজনীন শিক্ষা ও উচ্চতর গবেষণায় প্রভ‚ত সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। মানবাধিকারের ঘোষণায় একাত্মতা স্বীকার ও স্বাক্ষর করা দেশ হিসেবে বাংলাদেশও সব নাগরিকের শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নে সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে, বাংলাদেশে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সরকার সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক ব্যয়ভার নির্বাহ করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে এসব বিষয় স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়ন জরুরি। আদতে শিক্ষার কোনো লক্ষ্যই পুরণ করতে পারছে না সরকার। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কর্মমুখী শিক্ষার মান অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। একদিকে যথাযথ প্রশিক্ষিত, মানসম্মত শিক্ষকের অভাব অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেচ্ছ টিউশন ফি আদায়, কোচিং বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানামুখী অর্থনৈতিক চাপে নিস্পিষ্ট হচ্ছে দেশের প্রায় সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ ধারা বিদ্যমান আছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং পারিবারিক-সামাজিক অসচেতনতা। করোনাকালীন বাস্তবতায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল-মাদরাসা বিমুখ হয়ে ঝরে পড়ার তালিকায় স্থান পেয়েছে। করোনাত্তোর পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এসব শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা, কর্মসংস্থান ও আয় হ্রাসের বিপরীতে মূল্যস্ফীতির কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। ভোগ্যপণ্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন কাগজসহ সব শিক্ষাপোকরণের দাম বেড়েছে তখন বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি, বাধ্যতামূলক কোচিং ফিসহ নানা খাতে বাড়তি খরচের বোঝা বাড়িয়ে শিক্ষাব্যয় ক্রমেই দুর্বহ করে তোলা হচ্ছে। সরকার বিনামূল্যে প্রাথমিক, সুলভ মূল্যে মাধ্যমিক এবং মেধাবিদের জন্য বৈষম্যহীনভাবে উচ্চতর শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হলেও প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বৈষম্য ও বাণিজ্যিক প্রবণতা রোধ ও শিক্ষার ন্যুনতম মান নিশ্চিত করার যেন কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। নামি-দামি স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথেচ্ছ টিউশন ফি আদায় এবং নানা খাত দেখিয়ে ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফাবাজি এখন এমপিওভুক্ত সাধারণ কলেজগুলোতেও বিস্তার লাভ করতে দেখা যাচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি জাতির অন্ধকার ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে। সম্প্রতি মালালা ফাউন্ডেশনের এক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার শতকরা ৭৫ ভাগ। এটি অতি সাম্প্রতিক বাস্তবতা। এর পেছনে মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থা প্রধান ভ‚মিকা পালন করছে।

গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনস্থ বেসরকারী কলেজগুলোতে অস্বাভাবিক উচ্চহারের শিক্ষাব্যয়ের একটি খন্ডচিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে টিউশন ফিসহ নানা খাতে ক্রমবর্ধমান হারে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রতিযোগিতায় নি¤œবিত্ত পরিবারগুলোর নাজেহাল অবস্থা ফুটে উঠেছে। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা জাতীয়করণ করার পরও সরকারি নিয়মানুসারে শুধুমাত্র টিউশন ফি কমিয়ে অন্য সব খাতে বেসরকারি কলেজের মত অর্থ আদায়ের তথ্যও উঠে এসেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হলেও বিশ্ববিদ্যালয় তা পালন করতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়া নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবি সন্তানরাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এসব কলেজে অনার্স-মাষ্টার্স পড়তে আসে। অস্বাভাবিক উচ্চ হারে এডমিশন, রি-এডমিশন ফি, মাসে হাজার টাকা টিউশন ফি এবং দ্বিগুণ-তিনগুণ বাধ্যতামূলক কোচিং ফি’র কারণে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের পর শিক্ষার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ায় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়ার তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে শিক্ষায় মেয়েদের সাফল্যের হার কমে যাওয়ার পাশাপাশি ঝরে পড়ার শতকরা ৬ ভাগ বেড়ে যাওয়ার খবরও গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষাপোকরণের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষাখাতে বৈষম্য, লাগামহীন দুর্নীতি, মানহীনতা ও বাণিজ্যিক প্রবণতা রোধে এখনই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সেমিনার, অনুষ্ঠান, মিটিং ও প্রমোদ ভ্রমণে সময় পেলেও কাজের কাজ করার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার প্রমান দিয়ে যাচ্ছেন। তা নাহলে অধিভুক্ত কলেজগুলোর ফি আদায়সহ সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়। শিক্ষামন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ও শিক্ষা সংকোচন রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন