জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে এক শিক্ষকের অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ উঠেছে। নিজ বিভাগের ছাত্রীসহ বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নারী নেত্রীরাও ভুক্তভোগী বলে দাবি করেছেন সাবেক ছাত্রনেতারা। অভিযুক্ত শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনি। তিনি ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে, ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনি।
সম্প্রতি মাহমুদুর রহমান জনির সঙ্গে নিজ বিভাগের ৪২তম ব্যাচের ছাত্রী ও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষিকা আনিকা বুশরা বৈচির আপত্তিকর ছবি ফাঁস হয়। ছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর দেয়ালে পোস্টারিংও করা হয়। পোস্টারে ছবির ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, ‘এভাবেই ললিপপের ভেলকিতে শিক্ষিকা হলেন অনিকা বুশরা বৈচি।’
এরপর বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা জনির বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ তুলেছেন। এই প্রতিবেদকের কাছে জনির সাথে একাধিক ছাত্রলীগ নেত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিভিন্ন ছবি ও তথ্য প্রমাণ হাতে এসেছে।
বিশ^বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘ছাত্র অবস্থায় সে তার সহপাঠী নন্দিতা সরকারের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেন। বর্তমানে ওই সহপাঠী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ওই সহপাঠী ভিন্ন ধর্মের হওয়ায় তারা উভয়েই গোপনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে নন্দিতা সরকার উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিব কুমার সাহা বলেন, ‘জনির সাথে দীর্ঘদিন রাজনীতি করার কারণে আমি জানি, সে ছাত্রনেতা ও শিক্ষক থাকা অবস্থায় একাধিক ছাত্রলীগ নেত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। পাশাপাশি নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যের সাথেও জড়িত ছিলো জনি। সে আমার বান্ধবীকে শিক্ষক বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় যোগ্যতা সত্ত্বেও আমার বান্ধবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও একটি পদ খালি ছিলো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এক ছাত্রী বলেন, ‘আমাকে শিক্ষক বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে কুপ্রস্তাব দেয় জনি। আমি সবকিছু না জেনে রাজিও হয়েছিলাম। পরে জানতে পারি জনি বিবাহিত এবং একাধিক নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এরপর জনির কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় যোগ্যতা ও পদ খালি সত্ত্বেও আমাকে শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হয়নি। উপরন্তু যাকে নেওয়া হয়েছে তার সাথে জনির অন্তরঙ্গ ছবি ফাঁস হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও যোগ্য প্রার্থী ছিলো। অথচ আমরা পরে জেনেছি জনি ভাই পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা নন্দিতা সরকারের সাথে বিশেষ আইনে বিয়ে করেছেন।’
এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক নন্দিতা সরকার বলেন, ‘বিশেষ আইনে বিয়ের বিষয়টি আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটি পাবলিক করতে চাচ্ছিনা।’ ছাত্রলীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি মাজেদ সীমান্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে জানান, ‘জনি সভাপতি হওয়ার পর তার নোংরা রাজনীতি শুরু হয়। সে রেগুলার ইয়াবা আর ফেন্সিডিল খাইত। অথচ তাকে দেখলে মনে হয় ভাজা মাছও খাইতে পারেনা। তার রাজনীতি করায় আমরা সচক্ষে দেখতাম কিন্তু আমরা জুনিয়র থাকায় কিছুই বলতে পারতাম না। তার ব্যাচের এক হিন্দু দিদি (নন্দিতা সরকার) তাকে নিয়ে প্রাইভেট কারে ঘুরতে যেত। ওই দিদি চলে গেলে সে ৪২ আর ৪৪ ব্যাচের এর কিছু মেয়েকে রাজনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে সব সময়ই কাছে কাছে রাখতো, দুইজনকে আমি প্রায়ই তার সাথে প্রাইভেট কারে দেখতাম।’
২০১২ সালের শাখা ছাত্রলীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহমেদ রাসেল বলেন, ‘জনির এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকা ছাত্রলীগের জন্য বিব্রতকর। এটা নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। এগুলো সত্য প্রমানিত হলে তার শাস্তি হওয়া উচিত।’
এসব বিষয়ে মাহমুদুর রহমান জনি বলেন, ‘সহকারী অধ্যাপক নন্দিতা সরকারের সাথে আমার ১৪ বছরের সম্পর্ক আছে। তবে বিয়ের বিষয়টি ব্যক্তিগত হওয়ায় সেটি বলতে চাচ্ছি না।’ একাধিক নারী শিক্ষার্থীর সাথে ‘অশালীন’ চ্যাটিং এবং অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি মহল বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এই কাজগুলো করে যাচ্ছে। আর শিক্ষক নিয়োগে আমার কোন প্রভাব নেই, নিয়োগবোর্ড যাকে যোগ্য মনে করছে তাকেই নিয়োগ দিচ্ছে।’
এছাড়া সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষিকার সাথে আপত্তিকর ছবির বিষয়ে তিনি জানান, ‘ছবিটি বিভাগের আমার অফিসকক্ষে তোলা হয়। আমি একসময় ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সভাপতি থাকায় তখন অনেকেই আমার সাথে সেলফি তুলতো। আর বৈচি আমার বিভাগের ৪২ ব্যাচের ছাত্রী। আমি যখন শিক্ষক হই তখন তারা থিসিসের শিক্ষার্থী। তাই এই ব্যাচটার সাথে আমার সম্পর্ক অনেক ভালো।’
আনিকা বুশরা বৈচি বলেন, ‘আমি যোগ্যতার কারণে নিয়োগ পেয়েছি। ছবিটি অনেক পুরোনো। যারাই এটি ছড়িয়েছে তারা আমার সাথে অন্যায় করেছে। বিভাগের শিক্ষক হতে না পারার কারণে এটা কেউ করে থাকতে পারে।’
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আমরা যেসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি তা অস্বস্তিকর। একজন শিক্ষক হিসেবে এগুলো মেনে নেওয়া কঠিন। এসব সত্য হলে বিষয়টি নিন্দনীয়, একজন শিক্ষক তার অফিসকক্ষে এসব কাজ করতে পারে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মো. নূরুল আলম বলেন, ‘ওই শিক্ষকের বিষয়টি আমি জেনেছি। তবে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে আমার জানা নেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা ফলাফলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে কারো সুপারিশের সুযোগ নেই।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন