ইন্দোনেশিয়ায় সম্প্রতি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। এতে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অনেক। নিখোঁজ রয়েছে কয়েকশ’। প্রায় ২২ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাল-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ভূমিকম্প ইন্দোনেশিয়ায় মাঝে মধ্যেই হয়। যেমন অন্যান্য দেশেও হতে দেখা যায়। আর এটি এমন একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা অপ্রতিরোধ্য। ভূমিকম্প সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো: পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের শিলাখণ্ডের স্থিতিস্থাপকীয় বিকৃতি। বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প সৃষ্টির অন্য এক কারণও উদ্ভাবন করেছেন, সেটা হলো জলাশয় বেষ্টিত কম্পন।
ভারতের মহারাষ্ট্রের শিবাজিসাগর জলাশয়ের সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ৬.৫ রিখটার স্কেলের মাপে বেশ কয়েকটা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। বিশ্বের বেশ কিছু জলাশয় অঞ্চল যেমন: ভাগরাও লেক (সুইজারল্যান্ড), মারাথান লেক এবং ক্রেমাস্টা লেক (গ্রিস), গ্র্যান্ড ভেল লেক, (ফ্রান্স), লেক মিয়াড (যুক্তরাষ্ট্র), কার্ভিরা লেক (রোডেসিয়া-জিম্বাবুয়ে) ইত্যাদি অঞ্চলে এ রকম ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আগ্নেয়গিরির উৎপত্তির ফলে চুনাপাথরে দ্রবণ ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট গহ্বরে স্তর পতনের ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তির আশঙ্কা থাকে। অগ্নুৎপাতের সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জসহ ফিলিপাইন অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। ১৮৮৩ সালে জাভার ক্রকাটোয়ায় অগ্নুৎপাতের সঙ্গে ঘন ঘন ভূকম্পন হয়েছিল। তবে বেশিরভাগ ভূমিকম্পের কারণ যে ভূঅভ্যন্তরের সংঘটিত ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে সন্নিবিষ্ট, সে কথা আজ প্রায় সুনিশ্চিত।
১৯০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিকোতে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানী মি. এইচএফ রিড শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, যখন শিলাস্তরের নিজস্ব প্রতিরোধী ক্ষমতার ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি হয়, তখনই সে শিলাস্তর সঞ্চিত চাপ মুক্ত করতে শিলাচ্যুতির মাধ্যমে ভূআন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং তখনই ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটে। এভাবে ভূস্তরে ঘটা বিচ্যুতির জন্যই ক’বছর আগে ভারতের গুজরাটে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন। ভূমিকম্প উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা সক্ষমতা লাভ করেছেন এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ভূমিকম্প মাপক যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্পের কেন্দ্র নির্ণয় সম্ভবপর হয়ে উঠেছে এবং এর দ্বারা সম্ভাব্য ভূমিকম্পের স্থল বা বলয় চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ভূকম্পের এ বলয় পৃথিবীতে দুটো অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে আছে যেমন: (১) প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পূর্ব উপকূলের রকি, অ্যান্ড্রিজ ইত্যাদি পর্বতশ্রেণী অঞ্চল এবং পশ্চিম উপকূলের জাপান, ফিলিপাইন ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ, কেরিবিয়ান উপকূল, নিউগিনি, নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ কুমেরু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে (ঈরৎপঁস চধপরভরপ ইবষঃ সংক্ষেপে ঈচই)। (২) ভূমধ্যসাগরের চারদিকে আল্পস, ককেসাস ইত্যাদি পর্বতের আশপাশে, হিমালয় পর্বতমালার চারপাশ, মায়ানমার, নেপাল, আসামসহ কাশ্মীর ও পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এ বলয়ের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ভূতাত্ত্বিকরা ভূমিকম্পের আন্তর্জাতিক বলয়ের ও ভূমিকম্পের প্রাবল্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের পাঁচটি মণ্ডলে বিভক্ত করেছেন। এ গুলো হল: (১) জম্মু কাশ্মীরের এক বৃহৎ অংশ, (২) হিমাচল প্রদেশসহ মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের একাংশ, (৩) উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম পাহাড়ি অঞ্চল, (৪) বিহার, সিকিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহ (৫) আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং বাংলাদেশ।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস: ভূমিকম্পের সম্ভাব্য স্থান নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হলেও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হননি। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য কতকগুলো পন্থার উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেগুলো হলো: (ক) ছোট ছোট মধ্যম আকারের ভূমিকম্প বরাবর সংঘটিত হওয়া, (খ) প্রাকৃতিক ও গৌ তরঙ্গের গতিবেগের ব্যবধান, (গ) পূর্বে সংঘটিত হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের সময়ের ব্যবধান, (ঘ) ভূমিকম্পের পূর্বে নির্দিষ্ট অঞ্চলে ফাটলের সৃষ্টি এবং শিলাস্তরের আয়তন বৃদ্ধি, (ঙ) ভূমিকম্পের পূর্বে জীবজন্তুর অস^াভাবিক আচরণ এবং প্রাকৃতিক পরিবর্তন। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যানুসারে ভূমিকম্পের পূর্বে ভূগর্ভে অতি মৃদুকম্পন সঞ্চারিত হয় যা শুধুমাত্র সংবেদনশীল পশুপক্ষীরা অনুভব করতে পারে। তাই ওই সময় ওদের মধ্যে অস্বাভাবিক আচার-আচরণ লক্ষ করা যায়। তাছাড়া, ভূমিকম্পের পূর্বে পানিপৃষ্ঠের পরিমাপের বিভিন্ন তারতম্য ঘটে। এ সব বিষয়ের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৯৭৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চীনের হেইচেঙ্গে সংঘটিত বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, প্রায় ৪০ শতাংশ উচ্চমানের ভূমিকম্পের পূর্ব-প্রঘাত অনুভূত হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পূর্ব-প্রঘাত অনুভূত হয় ১২ আগস্ট। চীনের হেইচেঙ্গে সংঘটিত ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সঠিক হলেও ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই সে দেশের তাঙ্গশানে সংঘটিত বিশ্বের বৃহত্তম প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে ভূমিকম্পের পরিমাপ ছিল ৭.৮ রিখটার স্কেল, এতে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে। সরকারি মতে, সাত লক্ষ পাঁচ হাজার। সুদীর্ঘকাল ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সম্পর্কীয় গবেষণা চালাচ্ছেন এ রকম ত্রিশ জনের একটি গোষ্ঠীর সদস্য ইতালির ত্রিয়েস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূকম্পীয় বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট ভুকম্পবিদ মি. পাঞ্জার অভিমত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে ‘ভূমিকম্পের বিষয়ে এখনও আমরা প্রাক-নিউটন স্তরেই রয়েছি।’
১৮৮০ সালে জন মিলন নামের একজন বাস্তুকার ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র সিস্মোগ্রাফ উদ্ভাবন করেন এবং তখন থেকেই ভূমিকম্প নিয়ে বৈজ্ঞানিক চর্চার উদ্ভব হয়। বিগত শতাধিক বছর যাবৎ ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণসমূহ ও পূর্বাভাস নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান এবং রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা বিস্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন। দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের পরও একটি মধ্যম এবং ছয়টি বৃহৎ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ১৯৬০ সালে গামবেল নামের জনৈক বিজ্ঞানী একটা নতুন পরিসংখ্যান তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন এবং তাতে দেখা যায় বৃহৎ ভূমিকম্পের সংখ্যা ক্ষুদ্র ভূমিকম্পের চেয়ে অনেক কম। গুটেনবার্গ নামের একজন বিজ্ঞানী ভূমিকম্পের সংখ্যা এবং রিখটার স্কেলে দেখা ভূমিকম্পের মাত্রার মধ্যে একটা সমীকরণ উদ্ভাবন করেন যার দ্বারা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কিছুটা সম্ভবপর হয়।
১৯৭৯ সালে রিকিটেক নামের আরেক বিজ্ঞানী একটা পন্থা উদ্ভাবন করেন যার সাহায্যে ভূমিকম্পের ঘুরে আসার সময় নির্ণয় করা যায়। ওই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ৭ রিখটার স্কেলের উপরে সংঘটিত ভূমিকম্পে আক্রান্ত অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা বা পূর্বাভাস দেওয়া কিছুটা সম্ভবপর হয়েছে। ১৯৬৪ সালে জাপানের নিগটা অঞ্চলে এক বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, যার রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৭.৫। টুসনেজি বিকিটেকি নামের জনৈক জাপানি বিজ্ঞানী লক্ষ করেছেন বিশ বছর যাবৎ ওই স্থানের উচ্চতা ক্রমে বেড়ে বেড়ে হঠাৎ কমতে শুরু করেছিল এবং সে সময়েই ওই স্থানে ভূমিকম্প সংঘটিত হলো। ওই বিজ্ঞানীর মতে, ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পূর্বে দু’ধরনের তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। ওই দুটি তরঙ্গের সাধারণ অনুপাত হলো ১:৭৩। কিন্তু ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার বহু আগে থেকেই এ অনুপাত কমতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্লু মাউন্টেন লেক নামের একটি অঞ্চলে মাঝারি মাপের ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন কেনীয়বাসী মি. যশ অগ্রবাল এবং সে পূর্বাভাস অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় রিখটার স্কেলে ২.৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। অগ্রবাল তখন আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছিলেন। তিনি যে পদ্ধতিতে ওই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন সে পদ্ধতি ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন। ওই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে পরে ঈধষরভড়ৎহরধ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঞবপযহড়ষড়মু-র এক দল বিজ্ঞানী ক্যালিফোর্নিয়ার রিভার সাইড নামক স্থানে একটা ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবং সে পূর্বাভাস অনুসারে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী মতে, ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলের মাত্রা সঠিক হয়নি।
ভারতের হায়দরাবাদের ঘধঃরড়হধষ এবড়ঢ়যুংরপধষ জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব- এর সঞ্চালক ড. হর্ষকুমার গুপ্তা একজন সহযোগীর সাহায্যে শিলং অঞ্চলে ভূমির গতিবেগের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৯৮০ সালে ভবিষ্যদ্ববাণী করেছিলেন যে, মেঘালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের ভূমির আয়তন প্রসার ঘটার কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতে একটা বৃহৎ ভূমিকম্প ঘটতে পারে। তবে তার সঠিক সময় ক্ষণ দিতে পারেননি। ওই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় চার বছর পর ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর রিখটার স্কেলে ৬.১ মাত্রার এক ভূমিকম্প উত্তর-পূর্ব ভারতকে কাঁপিয়ে তুলেছিল এবং ওই ভূমিকম্পের প্রাবল্য ছিল আসামের কাছাড় এবং বাংলাদেশের সিলেট জেলায় সর্বাধিক। ঐ সময় এসব জেলায় বেশ কিছু লোকের মৃত্যু হয় এবং অনেক লোক গৃহহারা হন। পরে ড. হর্ষকুমার গুপ্তার গবেষণার প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল ১৯৮০ সালে তাঁরই উল্লেখিত মেঘালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের ওই অঞ্চলটি। ১৯৭৭ সালে ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. জয়কৃষ্ণ ঘোষণা করেন, আগামী দশকে উত্তর-পূর্ব ভারতে একটি বৃহৎ ভূমিকম্প সংঘটিত হবে। ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুতে অনুষ্ঠিত ঝঃৎড়হম গড়ঃরড়হ ওহংঃৎঁসবহঃধঃরড়হ সম্পর্কীয় আন্তর্জাতিক কর্মশালায় আসাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে পৃথিবীর ছয়টি বৃহৎ ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আগস্ট ২০০১ সালের আমেরিকার ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় আমেরিকা ভারতের ঐ তিনজন বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদের একটি যৌথ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এ রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বত্র সম্ভাব্য ভূমিকম্প নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সরকারি ও বেসরকারি স্তরে বিভিন্ন পন্থা উদ্ভাবনের কথা চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে যাতে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের করাল গ্রাস থেকে জনজীবন ও সম্পত্তি কিছুটা হলেও রক্ষা করা যায়। ওই সমীক্ষার রিপোর্টটি তৈরি করেছেন আমেরিকার কলোরাডো ও বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ভূতত্ত্ববিদ, যথাক্রমে রগার বিলহাস ও পিটার মলনার এবং ভারতের বাঙ্গালোরের আই আই এ-র বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ প্রফেসর বিনোদ গোড়। ওই ভূতত্ত্ববিদরা সুদীর্ঘকাল হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বত শিখরে আরোহণ করে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন, হিমালয়ের শিলাস্তরের পেন্ডটের দুটো সীমার মধ্যে ফাঁকের কোনও বিচ্যুতি ঘটেনি বিগত দু’শ বছর সময়ের মধ্যে। তাই ভূতত্ত্ববিদরা অনুমান করেছেন যে, হিমালয়ের শিলাস্তরের বিচ্যুতি ঘটতে চলেছে অতি নিকট ভবিষ্যতে এবং তখন এক ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হবে গোটা হিমালয় বলয়ে। যা বিগত দু’শ বছরের মধ্যে সংঘটিত ভূমিকম্পের প্রাবল্যের চেয়েও হবে প্রায় দশ গুণ বেশি। প্রায় পাঁচ কোটি জনবসতি অঞ্চল জুড়ে এ ভূমিকম্পের প্রসার ঘটবে। রিপোর্টে প্রফেসর বিনোদ গোড় লিখেছেন, ঞযরং রং হড়ঃ ধ ঢ়ৎবফরপঃরড়হ, রঃ রং ধহ ধংংবংংসবহঃ নধংবফ ড়হ ষড়মরপধষ ধংংঁসঢ়ঃরড়হং ধহফ নঁঃঃৎবংংবফ নু ধৎমঁসবহঃং নধংবফ ড়হ ভরবষফ ফধঃধ. ওই ভূতত্ত্ববিদরা যদিও বিগত দু’শ বছর সময়ের মধ্যে না ঘটা এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতার কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন কিন্তু কবে সে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিণ হবে সে বিষয়ে সঠিক কোনও সময়কাল দিতে সক্ষম হননি।
পৃথিবীর জš§লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত বহু প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। মানব সভ্যতা সৃষ্টি পরে খিস্টপূর্ব ৭০০ সালের পরবর্তীকালে প্রায় ১,০০০টা প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের তথ্য পাওয়া যায়। ৩৪২ সালে তুরস্কর আন্টাকিয়ায় এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মারা যায় প্রায় ৪,০০০। সর্বাধিক লোকের মৃত্যু ঘটে ১৫৫৬ সালের চীনের চাংচি অঞ্চলে সংঘটিত এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে। মৃতের সংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ। ১৯২০ সালে জাপানে সংঘটিত এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে মারা যান ২ লক্ষ লোক। ১৯২৩ সালে জাপানে সংঘটিত আরেক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে মৃত্যু হয় প্রায় দেড় লক্ষ লোকের এবং ধ্বংস হয় প্রায় পাঁচ লক্ষেরও অধিক ঘরবাড়ি।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত ভূমিকম্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৩৫ সালে পাকিস্তানের বালুচিস্থান, ১৯৮৮ সালে আর্মেনিয়া, ১৯৯০ ও ১৯৯৭ সালে ইরান, ১৯৯০ সালে ফিলিপাইনস, ১৯৯১ সালে আফগানিস্তান, ১৯৯২ সালে ইন্দোনেশিয়া, ১৯৯৫ সালে জাপান এবং ১৯৯৯ সালের ১৭ আগস্ট তুরস্কে সংঘটিত একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প, মৃত্যু হয় প্রায় ১৬,০০০ লোকের। স্যার এডওয়ার্ড গেইটের লেখা অ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অংংধস গ্রন্থে আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সংঘটিত বহু ভূমিকম্পের বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায়। ওই গ্রন্থে উল্লেখ করা মতে ১৫৪৮, ১৫৯৬, ১৬৪২, ১৬৯৬ এবং ১৭১৪ সালে আহোম রাজা রুদ্র সিংহের রাজত্বকালে আসামে প্রবল ভূমিকম্প হয় এবং বহু লোক হতাহত হয়। বিগত শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পগুলো সংঘটিত হয় যথাক্রমে ১৯৮১, ১৯৩০, ১৯৫০, ১৯৬৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৫ সালে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা: এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস এবং তা প্রতিরোধ করা অতীতের মতো অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভব হয়ে উঠবে না। তবে বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন উপগ্রহ ও অন্যান্য প্রযুক্তির মাধ্যমে যে ভাবে ঝড়-বাদলের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে ঠিক সেভাবেই হয়তো একদিন ভূমিকম্পের পূর্বক্ষণে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। তবে ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলের যে দিকচিহ্ন রেখা বিজ্ঞানীরা অংকিত করেছেন আজ অবধি সে দিকচিহ্ন রেখার অভ্যন্তরেই ভূমিকম্প সংঘটিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তাই ভূমিকম্পের করাল গ্রাস থেকে কীভাবে ঘরবাড়ি ও জন-প্রাণী রক্ষা করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
১৯৭৬ সালে চীনে টাংস্নেনে হওয়া বিধ্বংসী ভূমিকম্পে কমপক্ষে সাত লক্ষ লোক হতাহত হয়। প্রায় অর্ধেক লোকের মৃতদেহ পনেরো দিন পরে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। বহু লোক চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়জলের অভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সে সময় চীনে সরকার ও বিভিন্ন সে^চ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ দুর্যোগ পরিচালন ব্যবস্থা ছিল না বলেই বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। ১৯৯৩ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের লাটুরে সংঘটিত বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে যদিও উরংধংঃবৎ গধহধমবসবহঃ গঠন করা হয় কিন্তু এর কার্যকারিতা সম্বন্ধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ততটা গুরুত্ব দেয়নি, যার ফলে ২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারি গুজরাটে সংঘটিত বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব হয়নি এবং ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যে যথেষ্ট ত্রুটি ছিল বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কায় অযথা আতঙ্কিত না হয়ে যাতে ভূমিকম্পের পরবর্তী দুর্যোগের মোকাবিলায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিধি বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা এবং ভূমিকম্প ডিজাইন না থাকা ঘর-বাড়িগুলো শনাক্ত করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন