অগ্রহায়ণের শেষ রাত থেকে সকাল পেরিয়ে মেঘনা অববাহিকাসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে মাঝারী কুয়াশার সাথে তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ নামছে। গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ মৌসুমের সর্বনিম্ন ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছে। বরিশালে রেকর্ডকৃত এ তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের ৩.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচে। তবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিক ২৯.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যেই রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং’এ ভর করে ২৪ অক্টোবর মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের পরে দক্ষিণাঞ্চলের দরজায় শীত কড়া নাড়তে শুরু করে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই। কার্তিকের শেষ ভাগে তাপমাত্রা ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে। ৮ নভেম্বর বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে যায়। যা ছিল স্বাভাবিকের দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস কম। তবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে তা কিছুটা ওপরে উঠলেও এখন আবার নামছে। আবহাওয়ার দ্রুত এ পরিবর্তনে শিশুদের মাঝে নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ ব্যাধীর প্রকোপ বাড়ছে। এ অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ রোগীদের ভীড় ক্রমশ বাড়ছে।
এবার বছর জুড়ে বৃষ্টিপাতের আকালের পরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং’এ ভর করে অক্টোবরে বরিশালে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১৫০% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। যা আগের মাসে ছিল স্বাভাবিকের ৬.৬% বেশী। অথচ চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলই স্বাভাবিক বৃষ্টির মুখ দেখেনি। ফলে আমন আবাদ ব্যাহত হবার পাশাপাশি আউশের আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। আবার শীত আগেভাগে ঝেঁকে বসার সাথে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়ায় বোরো বীজতলাও কোল্ড ইনজুরির কবলে পড়ার আশংকায় ভুগছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধাগণ। চলতি রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের মাধ্যমে ১৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক ৩১৬ মিলিমিটারের স্থলে ৩৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হলেও অক্টোবরে স্বাভাবিক ১৭৬ মিলিমিটারের স্থলে বরিশালে ৪৪১ মিলি বৃষ্টিপাতের কথা বলেছে আবহাওয়া বিভাগ। অথচ দক্ষিণ উপকূল থেকে বর্ষা মাথায় করে দক্ষিণÑপশ্চিম মৌসুমী বায়ু বিদায় নিয়েছে গত ২০ অক্টোবর। কিন্তু সিত্রাং এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা উপকূলভাগে ধেয়ে এসে ২৪ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রবল বর্ষণে ভাসিয়ে দেয় বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল ।
এবার মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির অভাবে যেমনি বিভিন্ন ফসল আবাদ ও উৎপাদন ব্যহত হয় তেমনি শেষভাগের প্রবল বর্ষণেও আমন ও রবি ফসলের ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়ার এ তারতম্য দক্ষিণাঞ্চলে জনস্বাস্থ্যসহ কৃষি ব্যবস্থায়ও বিরূপ প্রভাব ফেলার আশংকা বৃদ্ধি করছে।
গত মে মাসের ঘূর্ণিঝড় অশনি’র প্রভাবেও এ অঞ্চলে আউশ ও তরমুজের সাথে গ্রীষ্মকালীন সবজির ব্যাপক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আগেই সিত্রাং দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমনের সাথে আগাম শীতকালীন সবজিরও ক্ষতি করেছে। তবে আমনের জমি থেকে দ্রুত পানি সরে গেলেও এ অঞ্চলের শীতকালীন সবজির পুরোটাই বিনষ্ট হয়েছে। প্রবল বর্ষণে পুরো দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও এক বর্গ ইঞ্চি ফসলী জমিও প্লাবণ মূক্ত ছিল না। গত এপ্রিলে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে স্বাভাবিক ১৩২ মিলিমিটরের স্থলে মাত্র ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৫.৬% কম। মে মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে ৫.৬% কম বৃষ্টি হয়েছে। অথচ ওই মাসেই ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’তে ৭ থেকে ১১ মে পর্যন্ত অতি বর্ষণে তরমুজসহ বিভিন্ন রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। জুনে স্বাভাবিক ৪৮৩ মিলিমিটারের স্থলে আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস ছিল ৪৬০ থেকে ৫১০ মিলি। কিন্তু ওই মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল স্বাভাবিকের ৪৪.৪৫% কম, ২৬৮.৫ মি.মি.। জুলাই মাসে স্বাভাবিকের প্রায় ৬৫% কম বৃষ্টিপাতের পরে আগস্টে বরিশালে স্বাভাবিকের ১৬.৪% কম বৃষ্টি হয়েছে। ্ওই মাসে বরিশালে ৪৩৩ মি.মিটারের স্থলে ৩৬২ মি.লি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
মৌসুমের প্রায় পুরেটা জুড়ে অনাবৃষ্টির পরে গত মাসে প্রবল বর্ষণে ফসলসহ স্বাভাবিক জনজীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করে। পাশাপাশি এবার তাপমাত্রার পারদ আগে ভাগেই স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়ায় সামনে কি পরিস্থতি সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধাগণও।
তবে আগেভাগেই তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়ায় শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের ঠাণ্ডাজনিত রোগ ব্যাধী থেকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ।
মন্তব্য করুন