রফিকুল ইসলাম সেলিম : বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের দাম ফের বাড়ছে। ওয়াসা পানির দামও বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সিটি করপোরেশন গৃহকর বাড়িয়েছে এমন অজুহাতে বাড়িওয়ালারা ঘরভাড়া বাড়ানোর নোটিস জারি করছে। স্কুল-কলেজে বেতন-ফি বাড়ানো হচ্ছে। চাল, ডাল, চিনিসহ বাজারে নিত্যপণ্যের দামও চড়া। এ মূল্যবৃদ্ধির হিড়িকে চরম দুর্ভোগে পড়েছে চট্টগ্রামের মধ্যবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্তরা। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।
কারণ যেহারে ব্যয় বাড়ছে সে হারে তাদের আয় বাড়ছে না। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ার পর এক দফা সবখাতে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। এখন গ্যাস, পানিসহ সেবাখাতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় আরও এক দফা মূল্যবৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে অথচ বাজারে এর প্রভাব পড়েনি, কমেনি গাড়ি ভাড়া।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে সিএনজি চালিত গণপরিবহনের ভাড়া বেড়ে গেছে। অটোরিকশায় চলছে ভাড়া নৈরাজ্য। এর সাথে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে রিকশাভাড়াও। কর্মজীবীদের আয়ের বিরাট একটি অংশ রাস্তায় যাতায়াত খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বাড়িভাড়া। মহানগরীর কোনো কোনো এলাকায় বাড়ি ভাড়া রাজধানী ঢাকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জনসংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এদের বিরাট একটি অংশ মধ্যবিত্ত-নিন্ম মধ্যবিত্ত। তারা ভাড়া বাসায় থাকেন।
ভোক্তা অধিকারকর্মীরা বলছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম খুব দ্রুত ব্যয়বহুল নগরীতে পরিণত হচ্ছে। নগরীর চকবাজারের বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন বলেন, বাড়িভাড়া এতো বেশি বেড়েছে, বেতনের অর্ধেকের চলে যাচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে এ অজুহাতে স্কুলের বেতন-ফিও বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় এখাতেও ব্যয় বেড়েছে। যাতায়াত খাতেও অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হচ্ছে। এতে করে আয়ের প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের মতো স্বল্প বেতনে যারা চাকরি করেন তাদের এখন সঞ্চয় বলে কিছু নেই।
আগ্রাবাদ হাজিপাড়ার বাসিন্দা কাজিমুর রহমান বলেন, গণপরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় যাতায়াত খাতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা, শিক্ষা সবখাতে ব্যয় বেড়েছে। ঘরভাড়া বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। সিটি করপোরেশন নগরীতে গৃহকর আদায়ের তোড়জোড় বাড়িয়ে দেয়ার পর থেকে বাড়িওয়ালারা ঘরভাড়া ভাড়াতে শুরু করে। বছর শেষে এমনিতে ভাড়া বাড়ানো হয়, তবে এবার গৃহকর বাড়ানোর অজুহাতে ঘরভাড়া বেশি ভাড়ানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি। যদিও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ করপোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, গৃহকর বাড়ানো হয়নি।
চলতি বছর এক একাধিকবার গ্যাস বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে আবাসিক গ্যাসের দুই চুলার জন্য মাসিক ৬৫০টাকা করা হয়েছে। এখন তা একলাফে মাসিক ১২শ’ টাকা এবং এক চুলার জন্য মাসিক এক হাজার টাকা করার তোড়জোড় চলছে। সিএনজি গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ টাকা করা হচ্ছে। নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় নিয়মিত গ্যাস পাওয়া যায় না। অথচ গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। গ্রাহকরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে গ্যাস চালিত যানবাহনের ভাড়াও আরেক দফা বাড়বে। তাছাড়া একজন আবাসিক গ্রাহককে চুলা প্রতি প্রায় দ্বিগুণ খরচ গুণতে হবে। এরফলে চরম সঙ্কটে পড়বেন নিন্ম ও সীমিত আয়ের লোকজন।
চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন পানির তীব্র সঙ্কট ছিল। নভেম্বর মাসে ওয়াসার এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্পটি চালু হয়। প্রায় ২৯ বছর পর নগরীতে পানি সরবরাহ বাড়ে। ওই প্রকল্প থেকে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দিচ্ছে ওয়াসা। এখন ওয়াসা দিনে নগরীতে ত্রিশ কোটি লিটারের বেশি পানি সরবরাহ করতে পারে। যদিও নগরীতে পানির দৈনিক চাহিদা ৫০ কোটি লিটারের বেশি।
এতদিন যেসব এলাকায় সপ্তাহে এক বা দুই দিন রেশনিং করে পানি দেয়া হতো, এখন সেসব এলাকায় প্রতিদিনই পানি মিলছে। একে পুঁজি করে বাড়িওয়ালারা বাসাভাড়া বৃদ্ধি করা শুরু করেছে। এখন পানির সঙ্কট নেই, সারাদিন পানি দেয়া হবেÑ এমন কথা বলে বাসাভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। পাঠানটুলির বাসিন্দা কাজল কান্তি জানান, নিয়মিত পানি দেয়া হবে এ কথা বলে মাসে তিনশ’ টাকা পানির বিল বাবত বাসাভাড়ার সাথে যোগ করে দিতে নোটিস দিয়েছেন তাদের বাড়িওয়ালা। অন্য দিকে চট্টগ্রাম ওয়াসাও হঠাৎ করে অভ্যন্তরীণ ক্ষতি কমানোর অজুহাত দেখিয়ে পানির দাম একসঙ্গে ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বসেছে। বর্তমান দরের চেয়ে আবাসিকে প্রতি ইউনিটে (এক হাজার লিটার) দুই টাকা ৩৯ পয়সা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা দাম বাড়ানোর অনুমতি চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
তবে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ বলছেন, দাম বাড়ানোর অনুমতি চেয়ে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। সেখান থেকে যত টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেবে তত বাড়ানো হবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীনে মোট সংযোগ লাইন আছে ৬৩ হজার ৫৪৫টি। এর ৮৮ শতাংশ সংযোগ আবাসিকে, বাকি ১২ শতাংশ শিল্প ও বাণিজ্যিকে। গত ১ জানুয়ারি থেকে পাঁচ শতাংশ পানির দাম বাড়িয়ে আবাসিক প্রতি ইউনিট ৭.৬১ টাকা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগে ২১ টাকা ৫৬ পয়সা নির্ধারণ করার পর তা-ই কার্যকর রয়েছে।
পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন-১৯৬৬ এর ২২(২) ধারামতে প্রতি বছর একবার করে পাঁচ শতাংশ হারে ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে। সে অনুযায়ী বছরের শুরুতে একবার বাড়ানোর পর এক লাফে আবাসিকে আরও ৩১.৪১ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ৪৮.৪২ শতাংশ হারে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের চিঠিতে বলা হয়, শ্রমিক কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষঙ্গিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে ওয়াসার এক ইউনিট পানি উৎপাদনে খরচ হয় ১৫.৬ টাকা। আর গড় বিক্রি হয় ৯.২৭ টাকায়।
ওয়াসার ‘চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুমেন্ট ও সেনিটেশন প্রকল্পের’ জন্য নেয়া ঋণের কারণে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে বিধায় আয় ব্যয়ের মধ্যকার অবস্থা ‘নাজুক’ হয়েছে। দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চট্টগ্রাম ওয়াসার মোট ব্যয় হয় ৭৭.৫৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ৩১.৫৬ কোটি টাকা ও পানি উৎপাদনে বিদ্যুতের জন্য ব্যয় হয় ২৯.৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে পানি বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ৫৩.২৯ কোটি টাকা। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে ২৪.২৫ কোটি টাকা।
ভোক্তা অধিকারকর্মীরা বলছেন, ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে গণশুনানির নিয়ম থাকলেও তা না করেই এই প্রস্তাব করা হয়েছে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ওয়াসার পানির দাম বাড়াতে গণশুনানির নিয়ম আছে। কিন্তু তারা তা না করেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পানি উৎপাদনে ব্যয়ের বিষয়ে ওয়াসার দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, তারা সব সময় সিস্টেম লসের কথা বলে থাকে। এটা বন্ধ করতে পারলে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। একদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে, তার উপর ওয়াসার এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে নগরীতে বাড়ি ভাড়া আরও বেড়ে যাবে। যার খেসারত দিতে হবে নিন্ম ও স্বল্প আয়ের লোকজনকে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি সুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষে বেসরকারি সেবখাতের উপর নির্ভরশীল। হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল কলেজ সরকারি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত হারে বেতন-ফি আদায় করা হচ্ছে। একই অবস্থা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও। অন্য দিকে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণেও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এতে করে নৈরাজ্য চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন