শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থনীতিতে অশনিসংকেত

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক তার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। এ কারণে, আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এই আশংকা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্যও চিন্তার বিষয়। বৈশ্বিক মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি। এরই মধ্যে বৈশ্বিক মন্দার পদধ্বনি চলছে দেশে দেশে। বিশ্ব অর্থনীতির এই মন্দার ঢেউ বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ। এরই মধ্যে দেশের প্রধান রপ্তানির বাজারগুলোর মধ্যে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। এ মন্দার প্রভাবে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগামী অর্থবছরে কমে যেতে পারে। তাই এ সময়টাতে সকলেরই সহনশীলতা জরুরি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, বাংলাদেশে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে দুর্ভিক্ষের শিকার না হয়, সেজন্য খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী অভয় দিয়ে আরো বলেছেন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। তার ভাষায়, সারা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা গেলেও ‘বাংলাদেশে ইনশাআল্লাহ দুর্ভিক্ষ হবে না’।

আসলে কি তাই? দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থা নিয়ে বিশ্লেষকদের আলোচনা-সমালোচনা এবং সরকার বিরোধীদের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা, রঙ্গ-ব্যঙ্গ, ট্রল চলছে সমানে। সেইসঙ্গে নাই-নাই শোরগোল এখন চারদিকে। দিনে দিনে স্যোশাল মিডিয়া উৎরে মূলধারার গণমাধ্যমেও রিজার্ভ ঘাটতিসহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার খবর-নিউজ আইটেম হয়ে যাচ্ছে।

কথা হচ্ছে, রিজার্ভ গেল কই? কেউ খেয়ে ফেলেছে? চিবিয়ে না গিলে? ব্যাংকগুলোর পুঁজি-পাট্টা ঠিক আছে তো? গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকগুলো? এসব প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন প্রোগ্রামে প্রধানমন্ত্রীই দিচ্ছেন। তাহলে বাদবাকিরা কই? মুখপাণ্ডিত্যে পাকা যে মহাশয়রা একেক সময় একেকটা বলে আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন, তারাই বা এখন কোথায়? সরকার রক্ষা, দল রক্ষার পাশাপাশি ওই দুধের মাছিদের রক্ষার দায়িত্ব ও কি প্রধানমন্ত্রীর? লক্ষনীয় বিষয়, সরকারের পক্ষে এসবের জবাব দেয়া যেন একা প্রধানমন্ত্রীরই দায়িত্ব।

বাস্তবতা হচ্ছে, সময়টা এমনিতেই খারাপ। মহামারি করোনার পর রুশ-ইউক্রনে যুদ্ধ। বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির জের বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে নজিরবিহীন হারে বেড়ে গেছে জ্বালানি, খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। রিজার্ভ যাচ্ছে কমে। এ কারণে ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এর বিপরীতে রয়েছে দেশের রাজনীতিতে অশনিসংকেত। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বুঝে উঠার আগেই ডালপালা গজাচ্ছে বিভিন্ন গুজবের। আর এই গুজব কখনও গণমাধ্যমে আবার কখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই। আসলেই কি এসব গুজব? সরকারি দলের তরফে বলা হচ্ছে, গুজবকারী কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এদের রুখে দেবে আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মী বাহিনী। তাহলে কই-কোথায় এ বাহিনী? এরা তো ব্যস্ত হানাহানিসহ নানান মন্দ কাজে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় এরা নিজেরা সংঘর্ষ করেছে। নিজেদের লোক হতাহত হয়েছে। দলের বড় বড় নেতাদের সামনেও এসব হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে তারা চেয়ার-টেবিলের নিচে পালান। আর দলের সাধারণ সম্পাদককে বলতে হয়, না এমন কিছু ঘটেনি। নিহতের সঙ্গে তাদের কাউন্সিলের কোনো সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, অন্তর্দলীয় সংঘাতসহ নানা দলীয়পনা, অনাকাক্সিক্ষত খবরদারির ব্যস্ততায় ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীরা ব্যস্ত নানা কথা-কুকথার খিস্তিখেউরে। ঝড় এলে তাদের ওপর আঘাত পড়বে না, ভাবটা এমনই। ঝড়ের তেজ বেশি পড়ে বড় বটগাছে। ভারটা প্রধানমন্ত্রীর ওপর দিয়ে তারা নিজেরা নির্ভার। ওই গাছের কাণ্ডকেই সব ভার দিয়ে দিলে ঢাল-পালা-লতা-পাতাদের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না, বিষয়টি কি এতো সহজ? অথচ, এ রকম সময়ে সরকারের চেয়ে সরকারি দলের দায়িত্ব কম নয়, বরং বেশি। নির্বাচন এগিয়ে আসছে, বিরোধী দল সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো প্রকাশ ও প্রচার বাড়িয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। ওই প্রচারে প্রভাব পড়ে জনমনে। ক্ষমতাসীনদের তা ভালো করেই জানা। তাদের দলীয় প্রধান অনেক কিছুতেই সক্ষম-পারঙ্গম, তা সত্য। তাই বলে প্রচার-অপপ্রচার-গুজব রোখার মতো সব তারই কাজ? মোটেই নয়।

ভেতরে-ভেতরে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ যাচ্ছে অনেকদিন থেকে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন আরো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশে পণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে। আমরা নাকি কিছুটা ভালো আছি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের চেয়ে। পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাকে তুলনীয় করা বাংলাদেশে জন্য সম্মানের নয়। কিন্তু সামনে অস্থিতিশীলতার আভাস আর অর্থনৈতিক অবস্থা আরো বিপদশঙ্কুলের বার্তা ঘুরছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট চলমান। ফলে শিল্প মালিকরা বড় সমস্যার মুখোমুখি। কৃষি-শিল্প উৎপাদন ধরে রাখতে হলে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ আবশ্যক। করোনা মহামারিতেও শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত ছিল। এ কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি খারাপ ছিল না। জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাসের আমদানি কমে গেছে। ফলে এখন গ্যাসের আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই।

দুর্গতি-দুর্যোগ নিয়ে রাজনীতি করতে নেই। তারপরও, হচ্ছে দেশে-দেশে। এ নিয়ে প্রচার-কুপ্রচারের ধুম। বিশেষ করে, খাদ্যের মতো নিত্যজরুরি জিনিসকে ইস্যু করে সরকার ফেলে দেয়া অথবা এ ইস্যুতে কায়দা করে সরকারের টিকে যাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি দেশেই চলমান। বাংলাদেশেও কোনো বিরোধীদল কখনো এ ধরনের সুযোগ কাজে লাগায়নি তার নজির কি আছে?

পরিশেষে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে অতিসম্প্রতি মাত্র ৪৫ দিন দায়িত্ব পালন শেষে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। উন্নত বিশ্বে ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় দেশগুলো দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করতে যারপরনাই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশেও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা অবস্থা, অনেক দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ফলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, পোশাক শিল্পে রপ্তানি হ্রাস ও দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের একটা আশঙ্কা রয়েছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন