করোনা মহামারীর দুর্যোগকে পাশে রেখেই খুলনা শিপইয়ার্ড আগের দুটি অর্থ বছরে প্রায় সোয়াশ কোটি টাকা নীট মুনাফা অর্জনের পরে গত অর্থ বছরেও প্রায় ৭০ কোটি টাকা কর পরবর্তী মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের দুটি অর্থ বছরে প্রায় ১৮৩ কোটি টাকা আয়কর ও ভ্যাট প্রদানের পরে গত অর্থ বছরেও প্রায় ১৪০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। গত অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটির টার্ণওভার ছিল ৮৪২ কোটি টাকারও বেশি। যার মধ্যে উৎপাদিত স্টিল সামগ্রী বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মতো। বিগত ৩টি অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটির টার্ণওভার ছিল ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকারও বেশি।
খুলনা শিপইয়ার্ডে প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশে আন্তর্জাতিক মানের একমাত্র মেরিন রাবার ফ্যাক্টরি স্থাপন করা হয়েছে। সাবমেরিনসহ বিভিন্ন যুদ্ধ জাহাজ এবং টাগ বোট, পন্টুন ও জেটিকে নিরাপদ রাখতে মেরিন রাবার আইটেম তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। যা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ে ভূমিকা পালন করছে।
এককালের লাগতার লোকসানী এবং রুগ্ন প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড ১৯৯৯ সালে নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পরে শুধুমাত্র সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধ্যবসায় ও নিরলস পরিশ্রমে সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলেই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নিট সম্পদের পরিমাণ প্রায় দেড়শ কোটি টাকার মতো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় দেড়শ কোটি টাকার দায়দেনা ও লোকসানের বোঝা নিয়ে খুলনা শিপইয়ার্ডকে স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন থেকে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। এ দুরদর্শী সিদ্ধান্ত কার্যকরের পরে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণভাবেই ঘুরে দাঁড়ায়। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণÑপশ্চিমাঞ্চলের সেরা করদাতার গৌরব অর্জনেও সক্ষম হয়েছে। খুলনা শিপইয়ার্ড গত এক যুগে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ছোট থেকে বড় মাপের যুদ্ধ জাহাজ ছাড়াও সাল্যজনকভাবে ‘সাবমেরিন হ্যান্ডলিং টাগ’ পর্যন্ত তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের আধা সামরিক বাহিনী কোস্ট গার্ডের জন্যও বিভিন্ন ধরনের পেট্রোল ক্রাফট এবং ফায়ার সার্ভিসের জন্য ফায়ার ফাইটিং বোট ও পন্টুন তৈরি করেছে। অদুর ভব্যিষ্যতেই প্রতিষ্ঠনটি ড্রেজার তৈরি করতে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
এসব বিশেষায়িত নৌযান তৈরির ফলে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গত ৩টি অর্থ বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার স্টিল ব্যবহৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে স্টিল সামগ্রী ব্যবহারই যেকোনো দেশের উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির ৩২ জন সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে ১ হাজার ৬৭৬ জন বেসামরিক কর্মকর্তা এবং শ্রমিক-কর্মচারী নিরলস পরিশ্রম করে শুধু বিশেষায়িত নৌযান নির্মাণ ও মেরামতেই নয়, অটোমোবাইল ট্রান্সপোর্ট মেরামত এবং নদ-নদীতে ড্রেজিং ও ভাঙন প্রতিরোধের কাজ করছে। এছাড়াও ১০ টন পর্যন্ত গান মেটাল ও হোয়াইট মেটাল ঢালাই, যেকোনো নৌযানের নকশা, স্টিল স্ট্রাকচারের ফেব্রিকেশন ও নকশা প্রনয়ণ করছে। খুলনা শিপইয়ার্ড যেকোনো নৌযানের মেরামতও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করছে।
ইয়ার্ডটি ইতোমধ্যে যুদ্ধ জাহাজসহ প্রায় ৮শ’ বিভিন্ন ধরনের নৌযান নির্মাণ ছাড়াও আড়াই হাজারের মেরামতের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। খুলনা শিপইয়ার্ড নির্মিত সবগুলো যুদ্ধ জাহাজই দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা সহ চোরাচালান প্রতিরোধ এবং সমুদ্র বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষায়ও নজরদারি করছে। নৌবাহিনীর জন্য চীনা কারিগরি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএসওসি সহযোগিতায় আরো ৫টি প্যাট্রোল ক্রাফট্ নির্মাণ করছে খুলনা শিপইয়ার্ড।
ইয়ার্ডটিতে প্রায় ৩শ’ ফুট দৈর্ঘের ৭শ টন উত্তোলনক্ষম ১০টি ট্র্যাকের সøীপওয়ের সাথে জেটিতে একইসাথে ৮টি নৌযান বার্থিং বা ভেরার ক্ষমতা রয়েছে। বছরে ৪ হাজার টন লৌহজাত সামগ্রী তৈরি করার ক্ষমতা সম্পন্ন এ ইয়ার্ডে বিভিন্ন ক্ষমতার একাধিক ওভারহেড ক্রেনসহ মোবাইল ক্রেন এবং ফর্ক লিফটারও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক সহায়ক যন্ত্রপাতিসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকা বায়ে নিজস্ব ‘ফেব্রিকেশন সেড’ গড়ে তোলায় সময় বাঁচিয়ে দ্রুত যেকোনো নৌযানের নির্মাণ কাজ শেষ করার দক্ষতা অর্জন করেছে।
এমনকি শিপইয়ার্ডটির প্লাটারসপ, ফেব্রিকেশন সেড, মেরিন ওয়ার্কসপ, ইলেকট্রিক্যাল ও রেডিও ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ার্কসপ, ফাউন্ডেরী সপ, কার্পেন্ট্রি সপ ছাড়াও ডকিং সেকশন ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক মেশিনারীতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ৩৩ মিটার উচ্চতা, ১শ’ মিটার লম্বা দ্বৈত ট্রাক সমৃদ্ধ ফেব্রিকেশন সেড-এ ২০ টন ক্ষমতার দুটি ওভারহেড ক্রেন রয়েছে।
খুলনা শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে কোস্ট গার্ড-এর জন্য একাধিক আধা সামরিক নৌযানসহ ফ্লোটিং ক্রেন বোট, টাগ বোট, পন্টুন ও ইনশোর পেট্রোল ভ্যাসেলও নির্মিত হয়েছে। দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দরের জন্য হেভি ডিউটি স্পীড বোট, পাইলট ভ্যাসেল ছাড়াও একাধিক টাগও নির্মাণ করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড।
এছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ’র জন্য একাধিক পন্টুন এবং দীর্ঘদিনের পুরনো দুটি ড্রেজার পুনর্বাসনের কাজও সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি আরো ৪টি ড্রেজার নির্মাণের লক্ষে নকশা প্রনয়ণ চলছে। বিআইডব্লিউটিসি ও নৌ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের জন্য ৬টি অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নৌযানও নির্মাণ করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড। মৎস্য অধিদফতর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর জন্য একাধিক অত্যাধুনিক গবেষণা নৌযানও নির্মিত হয়েছে এখানে।
এসব বিষয়ে খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর এম শামসুল আজিজ জানান, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়নতা নিয়ে কাজ করার ফলেই সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আগামী দিনে খুলনা শিপইয়ার্ড সাফল্যের উচ্চ শিখরে উপনীত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তৎকালীন পশ্চিম জার্মেনীর সহায়তায় ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন-এর মালিকানায় রূপসা নদী তীরে খুলনা শিপইয়ার্ডের যাত্রা শুরু হলেও জার্মান ও যুক্তরাজ্যের যৌথ ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হত। স্বাধীনতার পরে বিএসইসি-এর ব্যবস্থাপনায় কিছুদিন লাভজনকভাবে পরিচালিত হলেও পরবর্তিতে অব্যাহত লোকসানে প্রতিষ্ঠাটি বন্ধ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় করণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কয়েকবার বিক্রির চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠানটি নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। শতাধিক কোটি টাকা লোকসান ও দায়দেনাসহ ঐবছরই ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয় ইয়ার্ডটি।
খুলনা শিপইয়ার্ডের ঘুরে দাঁড়ান দেখে একইভাবে রুগ্ন ও লোকসানী নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ড ও চট্টগ্রাম ড্রাইডক নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই ইতোমধ্যে অব্যবস্থাপনা ও লোকসানকে পেছনে ফেলে সমৃদ্ধির নতুন অগ্রযাত্রায় যুক্ত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন