শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশকে পাল্টে দিতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি

আর কে চৌধুরী

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সমুদ্র অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে সমৃদ্ধির সোনালি শিখরে। এ খাতটিকে ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি। সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও সমুদ্রসীমা বিজয়ের ১০ বছরেও প্রস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ অনেক উদ্যোগ। এখন পর্যন্ত সমুদ্রের সম্পদ আহরণে অর্জিত হয়নি কোনো অগ্রগতি। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার প্রায় ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপরই সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও গবেষণায় সরকার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। সমুদ্রসীমা অর্জনের পরের বছরই ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৫ সালে সমুদ্র সম্পদ গবেষণায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ‘ব্লু ইকোনমি সেল’।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ। ২০১৮ সালে নৌবাহিনী সদর দফতরের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যানে সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাঁচ ধরনের কৌশল ঠিক করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। গত ১০ বছরে সমুদ্রসম্পদ নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর বাইরে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ছাড়া সম্পদ আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এদিকে হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বহুদিন ধরে সমুদ্র অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। ইন্দোনেশিয়া দ্য লোম্বক ব্লু ইকোনোমি ইমপ্লিমেন্টেশন প্রোগ্রাম- এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৭৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিসহ প্রতিবছর ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সামুদ্রিক সম্পদের উৎকর্ষসাধন ও পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বছরে আয় করছে প্রায় ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, যা তাদের জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। গত পাঁচ বছরে চীনের অর্থনীতিতে ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা চীনের মোট জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। এ ছাড়া, দেশটি ব্লু-ইকোনমি কেন্দ্রিক যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে ২০৩৫ সাল নাগাদ জিডিপিতে মেরিন সেক্টরের অবদান হবে প্রায় ১৫ শতাংশ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্লু-ইকোনমি হতে বাৎসরিক গ্রস মূল্য সংযোজন ৫০০ বিলিয়ন ইউরো এবং ৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি), জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ন কৌশলের মূলেও রয়েছে ব্লু-ইকোনমি (নীল অর্থনীতি)।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে বলা হয়, মাছের সোনালি ক্ষেত্র। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতি বছর ৮০ লাখ টন মাছ ধরা সম্ভব। অথচ সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করছে বছরে গড়ে মাত্র ৭ লাখ টন। এটি দেশে উৎপাদিত মোট মাছের সাত ভাগের এক ভাগমাত্র। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় বাংলাদেশের ভূভাগের সমান সমুদ্রসীমার অধিকারী হওয়া সম্ভব হয়েছে। এর ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে সমুদ্রসীমার বিপুল সম্পদ আহরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যাবে বলা হয় ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল ও গ্যাস রয়েছে। এখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে সেটা দেশের জন্য ব্লু ইকোনমির আরেকটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একান্ত অর্থনৈতিক এলাকার ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউসিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট থাকার বিষয়টি অনুমিত হয়েছে, যা ১৭ থেকে ১০৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের সমান। বাংলাদেশ জ্বালানি সঙ্কট রয়েছে। স্থলভাগে মজুদ প্রাকৃতিক গ্যাস শেষ হওয়ার পথে। সাগরে গ্যাস পেলে দেশের অগ্রগতির চাকা আরও বেগবান করা সম্ভব হবে। ব্লু ইকোনমির কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে এমনটিও আশা করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

সমুদ্র অর্থনীতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল এখন চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ। এ মুহূর্তে সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। ইন্দোনেশিয়া ৭৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানসহ বছরে ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র সম্পদ ও সমুদ্রনির্ভর পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সফল হচ্ছে। বাংলাদেশকে এ খাত এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দেশগুলোকে অনুসরণ করতে হবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন