বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশ নিয়ে উত্তেজনা ও সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টির তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিএনপি নয়াপল্টনে তার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের রাস্তায় সমাবেশের অনুমতি চাইলেও ডিএমপি ২৬টি শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। পুলিশের বেঁধে দেয়া ভেন্যু এবং অযৌক্তিক শর্ত মানতে রাজি নয় বিএনপি। তারা নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে অনড় রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, জনদুর্ভোগের প্রতিবাদ এবং দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ করেছে। পরিকল্পনা অনুসারে এই সিরিজের সর্বশেষ সমাবেশটি আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ঢাকার সমাবেশ থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে শুরু করে সিলেট, খুলনা, কুমিল্লাসহ প্রতিটি সমাবেশের আগেই সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করতে দেখা গেছে। এমনিতে কোনো বাধা না দেয়ার কথা বলা হলেও প্রতিটি সমাবেশের আগেই পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সব রকম পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে জনসমাবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করা হলেও সব বাধা উপেক্ষা করে প্রতিটি সমাবেশে লাখো মানুষের ঢল নামতে দেখা গেছে।
গত কয়েক বছর ধরে বিএনপিকে ঢাকায় বড় সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে পায়নি। বাধ্য হয়েই তারা নয়াপল্টনে সমাবেশ করে আসছে। সমাবেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার কথা বিবেচনা করে তারা এখানেই বিভাগীয় মহাসমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল। এমন বাস্তবতায় মহাসমাবেশের আগে অনুমতি দানে গড়িমসি এবং ২৬টি শর্ত জুড়ে দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়ার ঘটনাকে ভালো চোখে দেখছে না বিএনপি ও পর্যবেক্ষক মহল। বিএনপির প্রতিটি সমাবেশের আগে নানা অজুহাত দেখিয়ে পরিবহন মালিকদের ধর্মঘটসহ আওয়ামী লীগ ও পুলিশের নানাবিধ হয়রানিমূলক তৎপরতার চিত্র দেখা গেলেও সরকারি দলের সমাবেশগুলোতে বিপরীত দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে শত শত গণপরিবহন নিয়ে উৎসবের আমেজে সমাবেশ করা হয়। এসব সমাবেশে নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলাসহ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও সমাবেশের আগে পুলিশের পক্ষ থেকে এমন শর্ত বা অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বিএনপির সমাবেশ নির্বিঘ্ন করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে বলা হলেও সমাবেশের দিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়ে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দেশে নানামুখী সংকট ক্রমে ঘনীভূত হয়ে চলেছে। আগামী বছর অর্থনৈতিক সংকট আরো তীব্র হওয়ার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। এমতাবস্থায় দু’পক্ষ এক সঙ্গে মিলে আশঙ্কিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে, তেমন প্রত্যাশা থাকলেও সংঘাত সৃষ্টির আলামতই দেখা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দিয়ে, উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার পাঁয়তারা বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
দেশের মানুষ এক অভাবনীয় সংকটের মধ্যে পড়েছে। অযৌক্তিক ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েও দেশের মানুষ প্রত্যাশিত গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। আয় এবং কর্মসংস্থান না বাড়লেও নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ব্যাংকলুট, অর্থপাচার ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মকান্ড এ অবস্থার জন্য দায়ী। বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে পুরনো মামলাগুলোর পাশাপাশি নতুন করে মামলাবাজির অভিযোগ, হয়রানি, গণগ্রেফতারের কারণে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা আরো অবনতিশীল হয়ে উঠতে পারে। দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং সব উন্নয়ন অংশীদার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আগামীতে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতামূলক অবস্থানের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু আবারো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুলিশি ব্যবস্থার ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সরকারের অনুকূল নয়। এমতাবস্থায় সভা-সমাবেশে বাধা বা অযৌক্তিক শর্ত চাপিয়ে দিয়ে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দেয়া পরিণামদর্শিতার পরিচায়ক হতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন