সব দেশেই ব্যাংক জনগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ আস্থার জায়গা। আমাদের দেশে এই আস্থার জায়গাটিতে ফাটল ধরেছে অনেক দিন আগেই। এতদিনে সে ফাটল বড় হয়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক এখন অর্থ লুটপাট ও পাচারের অভয়ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকে বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে এবং ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট করেছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও টাকা চুরি হয়েছে। এসব দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ লুটপাটের তদন্ত, বিচার ও দায়ীদের শাস্তিবিধান হয়নি আজো। এর মধ্যে ৮টি ব্যাংকের এমডির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হয়েছে। তিনটি ব্যাংকের এমডি পলাতক রয়েছে। আর্থিক কেলেঙ্কারির দ্রুত বিচার ও শাস্তি হলে একই ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধ কমতো বলে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায়। মামলা করার ক্ষেত্রে গড়িমসি, তদন্ত করার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ এবং বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হওয়া আমাদের দেশে অতি সাধারণ বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাট ইত্যাদির সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের বখরাখোর একশ্রেণির উচ্চ পদাধিকারী তাদের সাঙ্গাত। উভয়ের পেছনে আবার ক্ষমতাসীনদের বরাভয়ও সক্রিয় রয়েছে। বস্তুত, এই তিন পক্ষের যোগসাজশে অর্থ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। এ যাবৎ লুণ্ঠিত ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আসেনি। ফেরত আনার কার্যকর চেষ্টাও দেখা যায়নি।
পত্রিকান্তরে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘ব্যাংক থেকে ঋণের টাকা বের করে নেবেন?’ উত্তরে বলা হয়েছে, ‘পদ্ধতি খুব সহজ। এ জন্য সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ভুয়া ঠিকানায় কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ঋণ নেওয়া।’ আরো বলা হয়েছে, ‘তবে এ জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মালিকপক্ষ ও ব্যবস্থাপনার যোগসাজশ লাগবে। আর প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক সম্পর্কগুলো ব্যবহার করা।’ এই ত্রয়স্পর্শজাত চুরি-দুর্নীতি-দুষ্কৃতি ও অর্থ লুটপাটের নজির উল্লেখ করতে গিয়ে রিপোর্ট পি কে হালদারের কীর্তিকর্মের প্রসঙ্গ সামনে এনে বলা হয়েছে, ‘পি কে হালদার অনেকগুলো কোম্পানি খুলে দখল করেছিলেন একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান।’ কীভাবে পি কে হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়েছিলেন, সে বিবরণ আগেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং উল্লেখ করা বাহুল্য। ব্যাংকিং সূত্রগুলোর বরাতে রিপোর্টে যোগ করা হয়েছে, এক সময় ব্যবসায়ীরা নিজের কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে ইচ্ছামতো ঋণ নিতেন। এক প্রতিষ্ঠানের কাছে যাতে বেশি ঋণ চলে না যায়, এ জন্য সীমা আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরই শুরু হয় অন্যের নামে ভুল নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। আবার অনেকে কোম্পানি না খুলে শুধু ট্রেডিং লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা করছেন। ব্যাংক থেকে তুলে নিচ্ছেন টাকা।’
জানা যায়, বহুল আলোচিত হলমার্ক সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছিল, তার কয়েকটি ছিল কাগজনির্ভর, অস্তিত্বহীন। এতে সোনালী ব্যাংকের লোকসান হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটাই এখন খেলাপি। জনতা ব্যাংক থেকে অ্যানন টেক্স নামের একটি গ্রুপ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়। এ জন্য ২২টি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে, যার মধ্যে অনেকগুলোই ছিল কাগুজে। এসব ঋণের বড় অংশ খেলাপী। এ রকম কাগুজে বা ভুয়া কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার আরো ঘটনা আছে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংকে।
সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকসহ ইসলামী ধারার অন্য দুটি ব্যাংক থেকে একইভাবে অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে এখন সর্বত্রই আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে। প্রকাশিত খবর মোতাবেক ১ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে দুই কোম্পানির নামে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। কোম্পানিদ্বয়ের ঠিকানা ভুয়া, দুটি কোম্পানিই কাগুজে বলে চিহ্নিত হয়েছে।
খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সব মিলিয়ে নানান উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ তোলা হয়েছে। অনুরূপভাবে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে আরো ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কথিত সব ঋণের সুবিধাভোগী ব্যাংক তিনটির মালিকপক্ষই। যেসব কোম্পানির নামে টাকা তোলা হয়েছে, তার মধ্যে একটির মালিকের ঠিকানা চট্টগ্রামে। আর বাকিগুলো রাজশাহীতে।
শুধু তাই নয়, ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়মরীতি না মেনে যথেচ্ছা টাকা তুলে নেয়ার আরো ঘটনা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বরাতে একটি ইংরেজি দৈনিকে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপ নামের একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৩০ হাজার কোটি টাকা। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, আইন ও নিয়ম-কানুন মানলে গ্রুপটি ওই ব্যাংক থেকে ঋণ পেতো ২১৫ কোটি টাকা। এর অর্থ দাঁড়ায়, গ্রুপটি যতটা ঋণ পাওয়ার যোগ্য তার চেয়ে ১৩৯ গুণ বেশি নিয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে, ওই গ্রুপটি ব্যাংকটির মলিকপক্ষ বলে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালে নানা নাটকীয় ঘটনায় মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম নামের ওই গ্রুপটি।
ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া এবং এস আলম গ্রুপটির ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হাইকোর্ট রিট করার পরামর্শ দিয়েছেন। হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আনা সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানিয়েছেন, তারা রিট করবেন। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফেও বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। এতে কৌশল-অপকৌশলে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া বন্ধ হবে কিনা বলা যায় না।
জামানত ছাড়া, ক্রেডিট রিপোর্ট ছাড়া ঠিকানাহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে, যার মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রও নথিতথ্যে নেই। এমন কি টেলিফোন নম্বর পর্যন্ত নেই। এমন ঋণের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, আন্দাজ করা যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে সচরাচর যা হয়, তা হলো, ব্যাংক লোকসানে পড়বে, ঋণ খেলাপি হবে। এই করে করে ব্যাংক দুর্বল হবে। দেউলিয়ার পথে পা বাড়াবে এবং অবশেষে দেউলিয়া হয়ে যাবে। ব্যাংক যে আস্থার জায়গা, ভরসার জায়গা, সেটা আর থাকবে না। আমনতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
ইসলামী ধারার তিন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়ার ঘটনায় জনমনে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন প্রচারণাও দেখা গেছে, ব্যাংক থেকে টাকা এভাবে তুলে নেয়া হলে টাকার অভাব দেখা দেবে। ব্যাংক টাকাশূন্য হয়ে পড়বে। আমানতকারীরা টাকা পাবে না। এই প্রচারণায় আমনাতকারীদের অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ব্যাংকব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট হয়েছে। ওদিকে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, স্বল্পতম সময়ে তড়িঘড়ি করে এত টাকা তুলে নেয়ায় আশঙ্কা হয়, এ টাকা পাচার হয়ে যেতে পারে। ব্যাংকে ডলারের অভাবের কথা কারো অজানা নেই। ডলারের অভাবে আমদানি কমানোর পরও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। অনেক ব্যাংকই ডলারের অভাবে এলসি খোলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ক’দিন আগের খবরে জানা গেছে, রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে। সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ বিষয়ে দেয়া বক্তব্য-মন্তব্য ব্যাংকসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে ১০টি ব্যাংককে ‘দুর্বল’ আখ্যায়িত করার কথা উল্লেখ করা যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের এটা বড় ভুল। এতে নানা গুজব ডালপালা বিস্তার করেছে। ব্যাংকে টাকা নেই। ব্যাংকের অবস্থা খুব খারাপ। ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি ধরনের উদ্বেগজনক কথা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। দুর্বল ব্যাংক থাকতেই পারে। সেটা যাদের জানার তারা জানবে। সাধারণ্যে তা প্রকাশ করা হবে কেন? এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতে হয়েছে, ‘ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ লিখিত দিয়ে যান, আমরা খতিয়ে দেখব।’ প্রধানমন্ত্রীকেও ব্যাংক নিয়ে, রিজার্ভ নিয়ে মুখ খুলতে হয়েছে। অভয় দিয়ে বলতে হয়েছে, ব্যাংকে টাকার কোনো অভাব নেই। রিজার্ভ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যথেষ্ট রিজার্ভ আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, পণ্যমূল্য, খাদ্য, সংস্থান, জ্বালানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, রাজস্ব আয় ইত্যাদি কোনো কিছুতেই সুখবর নেই। চলতি বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৬ দশমিক ১ শতাংশের ওপরে যেতে নারাজ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দেশের উন্নয়ন, দরিদ্র নিরসনের সম্পর্ক ওতপ্রোত। ইতোমধ্যে দারিদ্র্যের পরিধি বেড়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে কম করে হলেও ৩০ শতাংশ মানুষ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার মানে কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। রিজার্ভের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর। তাই রিজার্ভ কমে যাওয়ার অর্থ মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও নিত্যপণ্যের সঙ্কট তৈরি হওয়া। মূল্যস্ফীতি এখন ১০ শতাংশের ওপরে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, আটা, চিনি, শিশুখাদ্য ইত্যাদির অধিকাংশ মানুষের ক্রয়সামর্থ্যরে বাইরে। এ অবস্থা তাদের হতাশ ও বিপর্যস্থ করে ফেলেছ। জীবন বাঁচানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলেছে, আগামীতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যসঙ্কট এবং বেশ কিছু দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশও বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতির বাইরে থাকতে পারে না। এখনই এই ভরা আমন মৌসুমে চালের দাম লাগাতার বাড়ছে। মোটা চালও প্রতিকেজি ৬০ টাকার কম নয়। জ্বালানি তেলের দাম শুরুতেই বড় দাগে বাড়ানো হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুতের দামও বাড়ানো শুরু। বাড়ানো হবে বলে পাঁয়তারা চলছে। জ্বালানি-গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। জীবনযাত্রায় স্বস্তি উধাও হয়ে গেছে। সহসা সরবরাহ বাড়বে, দাম কমবে, এমন আলামত নেই। উৎপাদন ঘাটতি ও চাহিদার কমতিতে রফতানি আয় এরই মধ্যে কমেছে, রেমিট্যান্সও কমেছে। এ দুটি খাতের আয়ের ওপর অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা-শক্ত থাকা বিশেষভাবে নির্ভর করে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব আয়ও কমেছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বন্ধাত্ব আরো বেড়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান যে বাড়বে না, সে ব্যাপারে নিশ্চত হওয়া যায়।
এই সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিন ব্যাংকের ঋণকাণ্ড বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকের অতীতের কাণ্ডও এই সুযোগে সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। ব্যাংক যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ব্যাংক ছাড়া আজ কোনো দেশের কথা চিন্তা করা যায় না। ব্যাংকবিহীন বিশ্বও কল্পানাতীত। সেই ব্যাংকেরব্যবস্থা নিয়ে যখন মানুষ আস্থাহীনতায় ভোগে তখন দ্রুতই দেশের অবস্থা শোচনীয় ও বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বজুড়ে এখন একটা মন্দার আশংকা করা হচ্ছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই এর কারণ। মন্দা মোকাবিলায় ব্যাংকের ভূমিকা ইতিবাচক না হলে মন্দা আরো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অতীতে এরকম নজির রয়েছে। দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের নামে চুরির মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়ার পেছনে প্রধানত দুটি কারণ থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করতে হয় না বলে কারো কারো ধারণা। এ ধারণা মিথ্যে নয়, তার প্রমাণ রয়েছে ঋণ তামাদি বা খেলাপি হয়ে যাওয়ার মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার ওপর। এর মধ্যে কুঋণ ৮৮ শতাংশের বেশি, যা কখনই আদায় হবে না। এ ঋণ তারাই নিয়েছে, যারা মনে করে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দিতে হয় না। নানাভাবে পার পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করার উদ্দেশ্য থাকে। ভুয়া নাম-ঠিকানায়, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে যেসব ঋণ দেয়া হয়, তার একটা বড় অংশেরই এই উদ্দেশ্য থাকে এবং ওই টাকার পুরোটা বা অংশ বিশেষ পাচার হয়ে যায়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের মতে, ‘খেলাপি ঋণের বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। পাচার হওয়া অর্থ কখনোই ফেরত আসবে না। পাচার হওয়া অর্থে বিদেশে বাড়ি কিনেছেন পাচারকারীরা, সম্পত্তি কিনেছেন। পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে অনেকেই এখন ওইসব দেশে আসা-যাওয়া করছেন। একটা পর্যায়ে তারাও চলে যাবেন। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট, তার নেপথ্যে রয়েছে ঋণ ও দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার বেড়ে যাওয়া।’
দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার সাধারণ ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঋণের টাকা, দুর্নীতির টাকা কমিশন বাণিজ্যের টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, চুরির টাকা, দুই নম্বরী ব্যবসার টাকা, অবলীলায় পাচার হয়ে যায়। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার হয় অনেক বেশি। ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়। প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা পাচার হয়, সঠিক হিসাব দেয়া সম্ভব নয়। তবে গত বছর পত্রিকান্তরে এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, ৬ বছরে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই হিসাবে প্রতিবছর পাচার হয়েছে গড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
অব্যাহত দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচারে দেশ যে ফোকলা হয়ে গেছে বা যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছিদ্র পাত্রে পানি ঢাললে কোনো লাভ হয় না। আমরা উন্নয়নের জয়গান করি। বলি, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু সেটা কতটা প্রচারণা, আর কতটা সত্য, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই একটা হাহাকার অবস্থা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের বিকল্প নেই। দুর্নীতি, অপচয়, লুণ্ঠন, পাচার বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক খাতে সংস্কার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবান ব্যাংকব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবান অর্থনীতির পরিচয় বহন করে। রুগ্ণ-দুর্বল ব্যাংকব্যবস্থা, রুগ্ণ-দুর্বল অর্থনীতির প্রমাণ দেয়। ব্যাংক বা ব্যাংকব্যবস্থার প্রতি মানুষের অটল আস্থা অত্যন্ত জরুরি। আস্থা নষ্ট হলে কিংবা না থাকলে, গোটা অর্থনীতিতে ও অন্যান্য ব্যবস্থায় ধস নামতে বাধ্য। তাই ব্যাংককেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি-দুষ্কৃতির প্রতিটি ঘটনার অনুপুংখ তদন্ত করতে হবে। এ সবের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ব্যাংক নিয়ে আস্থার সঙ্কট দূর করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন