ব্যাংক হচ্ছে গ্রাহকের আমানত জমা রাখার নিরাপদ স্থান। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে জাল-জালিয়াতির কারণে ‘ব্যাংকে টাকা নিরাপদ’ থাকছে না। হলমার্ক, ব্যাসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিকে টপকে গেছে এস আলম গ্রুপের ইসলামী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি। একটি ব্যাংক থেকে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। জাল-জালিয়াতি করে এ ঋণ নেয়ার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় তোলপাড় চলছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ ধরনের জাল-জালিয়াতির ঋণ দেয়া ব্যাংকের মালিক-কর্মকর্তার যোগসাজস ছাড়া সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকে এক লাখ টাকা ঋণ নিতে হলে যত কাগজপত্র জমা দিতে হয়, ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কৃষককে জেলে যেতে হয়; সেখানে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ লেনদেন হচ্ছে। এ ঘটনা প্রকাশের পর ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে গেছে। মানুষ ব্যাংকের উপর আর আস্থা রাখতে পারছে না।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই ঋণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি। এক ব্যক্তির হাতে ৮টি ব্যাংক দিলে যে এ পরিণতি হবে তা আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবিরকে প্রকাশ্যেই বলেছিলাম। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এই দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না চাইলে কিছু হয় না। তিনি চাইলে এদের ধরা এবং টাকা উদ্ধার সম্ভব, অন্যথায় নয়।
দেশের ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়। ১০ হাজার টাকা ঋণ নিতে গেলেও ব্যাংকে এনআইডিসহ আনুষঙ্গিক অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়। ব্যাংক সেসব যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিয়ে থাকে। এতো নিয়মকানুনের মধ্যেই ক্ষমতাবান হলে হাজার কোটি টাকা ঋণ মিলছে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই! এমনকি তাদের নাম-ঠিকানার হদিস নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে কোনো বড় অঙ্কের ঋণ নিতে গেলে মর্টগেজের অনুসন্ধান হয়। প্রতিটি ব্যাংকের নির্দিষ্ট টিম আছে এর জন্য। সে টিম সব যাচাই-বাছাই করে পরিচালনা বোর্ডে প্রস্তাবনা পাঠায়। তারপর ঋণ অনুমোদন মিলে। যাতে ঋণফেরত আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। কিন্তু, দীর্ঘদিন থেকে বেনামি কিংবা সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানকেও বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় গত মাস নভেম্বরেই ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে এস আলম গ্রুপ তিন ব্যাংক থেকে সন্দেহজনক ঋণ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বরেই তুলে নেয়া হয়েছে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। অবশ্য ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ এ পর্যন্ত ঋণ পেয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, যদিও তাদের সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার কথা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ, এস আলম গ্রুপ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলো থেকে নিজ প্রতিষ্ঠান ও তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বেশিরভাগই ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া। গত কয়েক বছরে ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক যা বর্তমানে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মালিকানায় এসেছে। এসব অনিয়মের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটি রিপোর্টের বরাতেই দেয়া হয়েছে। আর সেখানে অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাই আদালত গত বুধবার ইসলামী ব্যাংক থেকে এই ঋণ নেয়ার ব্যাপারে রিট করতে বলেছেন। আর বৃহস্পতিবার আরেকটি আদালত এখন থেকে ঋণগ্রহীতার নাম ও ঠিকানা ব্যাংকগুলোকে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য তদন্ত শুরুর কথা বললেও ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করছে না। তবে সরকারও এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আর যে প্রতিষ্ঠানটি এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সেই এস আলম গ্রুপও মুখ খুলছে না।
অবশ্য ব্যাংক থেকে এভাবে ঋণ নেয়ার ঘটনা ‘সুপরিকল্পিত’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ব্যাংকে যারা নীতি-নির্ধারক এবং তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করে, যেমনÑ বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়Ñ সকলের যোগসাজশ না থাকলে এ ধরনের কাজ একের পর এক হওয়া সম্ভব নয়। একই সঙ্গে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নেয়া হলো, ব্যাংক কি ঋণ দেয়ার আগে সেসব যাচাই-বাছাই করেনি? দেশে ডলার, টাকা, গ্যাস, জ্বালানিসহ নানা ধরনের সঙ্কট চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি। সরকার দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে জনগণকে কৃচ্ছ্রতাসাধনের কথাও বলছে। অন্যদিকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা একটি গ্রুপকে একমাসে দিয়ে দিচ্ছে। সরকার কি তাহলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নাকি চাইছে না?
তথ্য মতে, সঠিক কাগজপত্র ও নিয়ম-কানুন মেনে আবেদন করে যেখানে ঋণ মিলছে না। সেখানে অসাধু চক্রটি ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। সব মিলিয়ে নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেয়া হয় গত মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এ কোম্পানিগুলো। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার সঙ্কটের পর টাকার সঙ্কট বড় আলোচনার বিষয়। ব্যাংক তিনটির নথিপত্র পর্যালোচনা করে এ সব তথ্য মিলেছে।
অথচ ব্যাংকের নথিপত্রে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডের অফিসের ঠিকানা বনানীর বি ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ভবন। ঋণ পাওয়া মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে মিলল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অফিস। তবে মার্টস বিজনেস লাইন নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। মূলত ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ঋণ নেওয়া এসব কোম্পানি। ফলে দ্রুত সময়ে এসব অর্থায়নের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে কি-না, সে প্রশ্নও উঠছে।
সূত্র মতে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১ প্রতিষ্ঠানের ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে ঋণ ছাড় বন্ধ রাখতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি গত সোমবার ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১ প্রতিষ্ঠানকে আগ্রাসীভাবে ঋণ দেয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের একটি টিম ব্যাংকটি পরিদর্শন করে এসব অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়েছে। এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। অবশ্য ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি টিম কাজ করবে। ইতোমধ্যে তারা একাধিক দিন ইসলামী ব্যাংকে গেছেন। আরও কয়েকদিন সেখানে যাবেন। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংক তিনটির কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি অনানুষ্ঠানিক জানালেও তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। এর আগে এসব ব্যাংকে একাধিকবার অনিয়ম ধরতে গিয়ে ফিরেও এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এখন অনেকটা চুপ হয়ে গেছেন।
এদিকে ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক (আইবিবিএল), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া ও এস আলম গ্রুপের ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, দুদক ও সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। গত রোববার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে আদালত এ আদেশ দেন। রুলে ঋণ বিতরণের অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা কেন দেয়া হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। চার মাসের মধ্যে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী ৫ এপ্রিল এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিনধার্য করা হয়েছে।
সূত্র মতে, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল আলম এখন সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন। বাংলাদেশ থেকে নামে-বেনামে অর্থ লুট করে ওখানেই শপিংমল, হোটেলসহ নানাবিধ ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
আর্থিক খাতের গবেষক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের এই ঋণের ঘটনা মহাকাব্যিক। এত বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা আগে আর ঘটেনি। অটিটি ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরকে (ফজলে কবির) বলেছিলাম এস আলম সাহবের সাথে সব সময় একটি করে অ্যাম্বুলেন্স দিয়েন। কারণ, তিনি যদি কোনো কারণে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান, তাহলে গ্রাহকদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেরকমই হলো। একই সঙ্গে এটা তো একবারে হয়নি। সরকার জানে, বাংলাদেশ ব্যাংক জানে, তারপরও ব্যবস্থা নেয়নি। এর আগেও ঋণের নামে লুটপাট হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়।
তিনি বলেন, এই টাকা আর ফেরত আসবে না। অতীতেও আসেনি। এক সপ্তাহ আগেই তো এস আলম সাহেব পৌনে ২০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সিঙ্গাপুরে হোটেল কিনল। এটা তার তিন নাম্বার হোটেল। এরপর শপিং মল আছে। সিঙ্গাপুরের বাইরেও আছে। তাহলে টাকা কীভাবে আসবে প্রশ্ন রাখেন। বাংলাদেশে যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুটপাট এখন সবচেয়ে সহজ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের সঙ্গে ভালো যোগাযোগের কারণে তারা আটটি ব্যাংক পেয়েছে। হাইকোর্ট যে দুই-একটি ব্যাপারে কথা বলছে তাতে আসলে কোনো কাজ হবে না। সরকার না ধরলে তাদের কেউ ধরতে পারবে না। আর এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি আরো ক্ষতির মুখে পড়বে। ব্যাংক খাতে সাধারণ মানুষের আস্থা আরো কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় এমন বড় অনিয়ম কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হয়ে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওপরের নির্দেশের জন্য বসে থাকলে চলবে না।
সরকারের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠন ও সেই অর্থ বিদেশে পাচার দেশে ডলার সঙ্কটের অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষক প্রফেসর ড. আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘কৃচ্ছ্রতাসাধন বা দুর্ভিক্ষসহ নানা ধরনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো ক্ষমতাহীন নাগরিকদের জন্য। আর ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে ঋণখেলাপি হওয়া বা সম্পদ পাচার করা, আমলাদের বিদেশ সফর, মন্ত্রী-সচিবদের সম্মিলিত ভোগবিলাস, সব কিছুই চলছে। এখানে কৃচ্ছ্রতাসাধন নেই। তার মানে হলো একটা সঙ্কটের কথা বলে জনগণকে নিরস্ত করা, যাতে জনগণ তাদের অধিকার না পায়। যেমনÑ বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যে দাম বাড়িয়েছে। এগুলোকে রেশনালাইজ করতে কিংবা জনগণ যাতে এগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ না হয়, সেজন্যই যুদ্ধসহ নানা কিছু বলে কৃচ্ছ্রতাসাধনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, এ অবস্থার আড়ালে সরকারের ঘনিষ্ঠগোষ্ঠী ঠিকই অধিক হারে লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচার করছে। ঋণখেলাপিদের যে টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে বেনামে যে টাকাটা তোলা হয়েছে, এই টাকা তো দেশে নেই, বিদেশে চলে গেছে। ডলার করে এগুলো বিদেশে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো আড়ালের জন্যই কৃচ্ছ্রতাসাধনের কথা বলা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ইসলামী ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর একটি। ভালো শিল্প গ্রুপগুলো ছিল ব্যাংকটির গ্রাহক। ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতমুক্ত করার ‘সরকারি আবেদনে’ সাড়া দিয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মালিকানা পরিবর্তনের ৬ বছরের মাথায় ভালো গ্রুপগুলো ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর শীর্ষ গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্বল্পখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান। এই সময়ে জনবল বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার। নতুন জনবল নিয়োগে মানা হয়নি কোনো নিয়ম-কানুন। অনেকেরই নেই প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট। ২০১৭ সালে জনবল ছিল ১২ হাজার ৫০০। বর্তমানে জনবল ২২ হাজারের বেশি। সাবেক কর্মকর্তাদের ৬০০ জনের আইডি ক্লোজড করা হয়েছে, অনেককে জোরপূর্বক অবসরে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য ব্যাংকে চলে গেছেন। যদিও গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে জনবলের হিসাব দেয়া হয়েছে ১১ হাজার ৩৮১ জন। অবশ্য এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন অন্যান্য ব্যাংকগুলোরও একই দশা। ভালো ব্যাংকাররা ইতোমধ্যে অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন