হাসান সোহেল : সারাবিশ্বে ব্যাপক হারে বাড়ছে অসংক্রামক রোগ ও স্থূল মানুষের সংখ্যা। অসংক্রামক রোগে (বিশেষ করে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হƒদরোগ) প্রতি বছর বিশ্বে বসবাসকারী মানুষের একটি বড় অংশ অকালে প্রাণ হারায়। আর এর পেছনের মূল কারণ চিনিযুক্ত পানীয়। গত ১১ অক্টোবর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের মানুষকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, দাঁতের ক্ষয়রোগ এবং অসংক্রামক রোগ থেকে বাঁচাতে চিনিযুক্ত পানীয়র খুচরামূল্য ২০ শতাংশ বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী স্থূলতা এবং ডায়াবেটিকে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ার অন্যতম কারণ চিনিযুক্ত পানীয় পান। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের পরিচালক ড. ডগলাস বেটচার বলেন, চিনিযুক্ত পানি পান কমিয়ে একজন মানুষ যেমন সুস্থ থাকতে পারে, তেমনি স্বাস্থ্য সেবা খরচ অনেকাংশে হ্রাস করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বাড়ছে বার্ধক্যজনিত রোগও। পাশাপাশি অস্টিওপরোসিস, আর্থোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ আর ক্যান্সারসহ নানা অনিরাময়যোগ্য রোগও সমান তালে বেড়ে চলেছে। যদিও প্রতিষেধক ব্যবহারে সংক্রামক রোগ কমলেও, আশংকাজনকহারে বেড়েছে অসংক্রামক রোগ। আগামী ১০ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে ৭৫ শতাংশ হতে পারে বলেও আশংকা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, গড় মৃত্যুর অর্ধেকের বেশির জন্য দায়ী অসংক্রামক রোগ। একই সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই অসংক্রামক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানেই বেড়েছে ৭ শতাংশ। ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ৯৭ শতাংশের কমপক্ষে একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি আছে। আর এই জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের আছে দু’টি রোগের ঝুঁকি। পাশাপাশি এসব রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এদিকে এ সব রোগ মোকাবেলায় জাতীয় কোন দিকনির্দেশনা নেই। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে।
অসংক্রামক রোগের কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘হেলথ বুলেটিনে’ বলা হয়েছে- খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ন, ধূমপান, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের প্রসার, বায়ুদূষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, মানসিক চাপের কারণে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। প্রতিবেদনে হৃদরোগ, স্নায়ুবিক রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, স্থায়ী বক্ষব্যাধি, আর্সেনিকোসিস, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, মুখের রোগ- এগুলোকে অসংক্রামক রোগ বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে পানিতে ডোবা, সাপে কামড়, আত্মহত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, এ্যাসিডে পোড়া রোগীদেরও এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, ২০১৪ সালে বিশ্বে প্রাপ্ত বয়স্ক স্থূল লোক ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্বের মোট বসবাসকারী প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই স্থূল। এর মধ্যে ১১ শতাংশ পুরুষ এবং ১৫ শতাংশ নারী মেদবহুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৪২ মিলিয়নই অধিক ওজনের বা স্থূল। যা গত ১৫ বছরে ১১ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪৮ ভাগ এশিয়ার এবং ২৫ ভাগ আফ্রিকার। পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, ১৯৮০ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিকে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ১০৮ মিলিয়ন। ২০১৪ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২২ মিলিয়নে। ২০১২ সালে শুধুমাত্র এ রোগে সারা বিশ্বে দশ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, পুষ্টিগত চাহিদা মেটাতে সুস্থ মানুষের চিনি খাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে সংস্থার স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. ফ্রান্সিসকো ব্রানকা বলেছেন, সংস্থার নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী খাদ্য তালিকাগত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, চিনি এবং চিনিযুক্ত পানীয় মানুষের খাদ্যতালিকায় অপ্রয়োজনীয় ক্যালরির একটি প্রধান উৎস। বিশেষ করে শিশু, কিশোর, তরুণ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে। চিনিযুক্ত পানীয় অস্বাস্থ্যকর এবং ব্যয়বহুল। যা খাবারের মূল্যকে বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে খাদ্যাভ্যাস উন্নতি এবং অসংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কৌশলগত বৈঠকের আয়োজন করে। সেখানে তাজা ফল খাওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে ফল ও সবজির দাম কমাতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ভর্তুকিরও সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নির্দিষ্ট খাবার এবং পানীয়, চর্বিযুক্ত খাদ্য, ট্রান্স ফ্যাট, চিনি অথবা লবণ ইত্যাদি খাবারে উচ্চ করারোপের সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রতিও জোর দেয়া হয়। এই সুপারিশের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে ম্যাক্সিকো, হাঙ্গেরি, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ড চিনি ও লবণযুক্ত খাবারের ওপর উচ্চ কর আরোপ করেছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে (২০১৩-২০২০) গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান-এ মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রণয়নে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়। কারণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে বিশ্বে ৩৮ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এরমধ্যে ১৬ মিলিয়ন মানুষ অংসক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারান। যার ৮০ ভাগই উন্নয়নশীল দেশে।
সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) এজেন্ডা অনুযায়ী, সদস্যরাষ্ট্রের সরকারগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হার্ট, এবং ফুসফুসের রোগ থেকে অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনতে ২০৩০ সালের একটি লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, মানসিক চাপ, ধূমপান, ভেজাল খাবার, বায়ুদূষণের কারণে অসংক্রামক রোগ বাড়ছে। ফাস্ট ফুডে অভ্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণেও এর ঝুঁকি বাড়ছে। তিনি বলেন, ভেজাল, ধূমপান, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে। আর দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অধিক বয়স্ক লোকের সংখ্যা এবং অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্থিক অসচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে। এ সব রোগের চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ করার বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন