খুলনার নদী, খাল ও সরকারি খাস জমি দখল করে গড়ে ওঠা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ১৪ টি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে উচ্চ আদালত আদেশ দিয়েছিলেন এক বছর আগে। সে সময় উচ্ছেদ অভিযানে নেমে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে স্থানীয় প্রশাসন। কারণ ইটভাটাগুলোর মালিকদের তালিকায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, শ্রমিকলীগ নেতা, সৈনিকলীগ নেতা। এমনকি বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতারাও রয়েছেন এ তালিকায়। ইটভাটাগুলোতে প্রতিদিন পুড়ছে কাঠ-কয়লা। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চ আদালতের চেয়েও প্রভাবশালী মহল আরও অনেক বেশি শক্তিশালী-তা প্রকারন্তরে বারবার প্রমান হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডুমুরিয়া উপজেলার নদীর দুই পাড়ে কয়েক শ’ বিঘা সরকারি জমি দখল করে ১৪ টি অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এ ভাটাগুলো হচ্ছে ডুমুরিয়া কুলবাড়িয়া-বরাতিয়া ও ভদ্রাদিয়া মৌজার ভদ্রা নদীর তীরবর্তী এসবি ব্রিকস, একই মৌজার স্থানীয় সংসদ-সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের কেপিবি ব্রিকস, কুলবাড়িয়া বরাতিয়া ও খর্নিয়া মৌজার ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য গাজী এজাজ আহমেদের সেতু-১ ব্রিকস, বিএনপি নেতা মোল্যা আবুল কাশেমের জামাই শাহজাহান জমাদ্দারের নূরজাহান-১ ব্রিকস ও শান ব্রিকস, ডুমুরিয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী হুমায়ুন কবির বুলুর ছেলে সালেহ আকরাম মাহির কেবি-২ ব্রিকস, রানাই মৌজার ভদ্রা নদীর তীরে সোবাহান সানার এফএমবি ব্রিকস, রানাই মৌজার হরিনদী তীরের জাহিদুল ইসলামের কেবি ব্রিকস (বর্তমানে বন্ধ), উপজেলা শ্রমিক লীগের সাবেক আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন বিশ্বাসের আল-মদিনা ব্রিকস, মশিউর রহমানের মেরি ব্রিকস, উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য সচিব আব্দুল লতিফ জমাদ্দারের জেবি ব্রিকস-১, আমিনুর রশীদের লুইন ব্রিকস, চহেড়া মৌজার হরিনদী তীরে রুদাঘরা ইউপি চেয়ারম্যান গাজী মো. তৌহিদুজ্জামানের ভাই এবং উপজেলা সৈনিক লীগের আহ্বায়ক গাজী আব্দুল হকের সেতু-৪ ব্রিকস এবং রুদাঘরা মৌজার হরিনদী তীরের গাজী ইমরানুল কবিরের টিএমবি ব্রিকস। এ তালিকার বাইরে বাইরে আরও ৯ টি ইটভাটা অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার ৭ দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনা জারি করতে বলেন হাইকোর্ট। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব এবং পরিবেশ সচিবকে এ নির্দেশনা জারি করতে বলা হয়। এর আগে, খুলনার হরি ও ভদ্রা নদীর জায়গা দখল করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটা উচ্ছেদে জনস্বার্থে ২০২১ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে হরি ও ভদ্রা নদীর সীমানায় সিএস, আরএস রেকর্ড অনুসারে জরিপ করে দখলদারদের তালিকাসহ ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে খুলনা জেলা প্রশাসন ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এরপর জেলা প্রশাসক ২০২১ সালের অক্টোবরে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেন। এরপর উচ্চ আদালত এসব ভাটা মালিকদের দখলে থাকা সরকারি জমি উচ্ছেদ করে অবমুক্ত করার নির্দেশ দেন। তবে ওই নির্দেশের পর এক বছর পার হতে চললেও কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেনি প্রশাসন।
জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স প্রদানের অন্যতম শর্ত, ইট তৈরির জন্য মজাপুকুর, খাল-বিল, খাড়ি-দিঘি, নদ-নদী বা হাওড়-বাঁওড় থেকে মাটি ব্যবহারে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। তবে ভাটা মালিকরা সে নির্দেশনাও মানছেন না। অবাধে নদীর মাটি ব্যবহার করছেন।
স্থানীয়রা জানান, শীতকাল থেকে শুরু হয়ে বর্ষার আগ পর্যন্ত চলে ইট পোড়ানোর কাজ। ধোঁয়া আর ধূলিতে ভরে যায় গ্রামের গাছপালা ও বাড়িঘর। ইটভাটা সংলগ্ন সকল গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষ অ্যাজমা, হাঁপানি ও কাশিতে ভোগেন সারা বছর। ইটভাটার জন্য মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। মাঝে মাঝে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে। পরে আবার শুরু হয় ইট বানানো ও পোড়ানোর কাজ।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য নারায়ন চন্দ্র চন্দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদ জানান, ইটভাটায় নিজস্ব জমিসহ স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া জমি কিনে ভাটা পরিচালনা করছি। আমার ইটের ভাটা অবৈধ নয়।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরীফ আসিফ রহমান জানান, আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ করছে প্রশাসন। ইটভাটায় কতটুকু খাস জমি বা নদীর জায়গা দখল করা হয়েছে তা পরিমাপ করে দেখছেন তারা। ভাটার মধ্যে খাস জমি পাওয়া গেলে সেখানে থাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছেন তিনি। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
পরিবেশ অধিদফতর খুলনার বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর সমগ্র বিভাগের অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। এ জন্য একটি কমিটি গঠন পূর্বক অবৈধ ইটভাটার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়ায় ৮ টি ইটের ভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। খুলনায়ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন