বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পবিত্র কোরআনের আলোকে পাঞ্জেগানা নামাজের বিবরণ

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

এদেশের মুসলিম সমাজে এক শ্রেণীর বিভ্রান্ত চিন্তাধারার লোক আছে, যারা অফিস-আদালত ও নানাস্থানে বলে বেড়ায়, কোরআনের কোথাও পাঞ্জেগানা নামাজের সময়ের উল্লেখ নেই। তারা খোদাদ্রোহী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে এরূপ বলে বেড়ায়। তাদের কুপ্রভাব অন্যদের মাঝেও বিস্তার লাভ করে। আবার এমন কিছু আধুনিক শিক্ষিত লোকও আছে, যারা নামাজ পড়াকে বোঝা মনে করে এবং অলসতা বা অনীহার কারণে যথাসময়ে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত নয়। তারা মনে করে থাকে, তারা খুব কোরআন বোঝে, কোরআনের কোথাও নামাজের সময় দেখতে পায়নি। নামাজের সময় সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টিকারীদের এবং কোরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তদের অবগতির জন্য কোরআনের বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত আয়াতগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা নিম্নে তুলে ধরা হলো। সূরাগুলো হচ্ছে সূরা হুদ, সূরা বনি ইসরাইল, সূরা তা’হা এবং সূরা বাকারার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোর আলোকে পাঞ্জেগানা নামাজের ওয়াক্ত (সময়) বর্ণিত হয়েছে। কোরআন সম্পর্কে অজ্ঞের দল এগুলো পাঠ করলে তাদের অজ্ঞতা দূর হবে। আয়াতগুলোর অর্থ:

১) সূরা হুদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তুমি সালাত কায়েম কর, দিবসের দুই প্রান্ত ভাগে ও রজনীর প্রথম অংশে (আয়াত: ১১৪)।
কোরআনের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনে কাসীরের মতে, এ আয়াতে মোট পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সময় করা হয়েছে এইভাবে: দিবসের প্রথম প্রান্তভাগ ফজরের সালাত, দ্বিতীয় প্রান্তভাগ জোহর ও আসরের সালাত এবং রাত্রির প্রথমাংশে মাগরিব ও ইশার সালাত। এ আয়াতে সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ রসূলুল্লাহ (সা.)কে লক্ষ্য করে তাঁকে ও তাঁর সমস্ত উম্মতকে দেয়া হয়েছে। ওলামায়ে তফসীর, সাহাবী ও তাবেয়ীগণ একমত যে, আলোচ্য আয়াতে সালাত অর্থ ফরজ নামাযকে বোঝানো হয়েছে (তফসীরে কুরতুবী) এবং একামতে সালাত অর্থ পাবন্দীর সাথে নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করা। কোনো কোনো আলেমের মতে, নামাজ কায়েম করার অর্থ সুন্নাত ও মুস্তাহাবসহ নামাজ আদায় করা। কারো মতে, এর অর্থ মুস্তাহাব ওয়াক্তে নামাজ পড়া। আয়াতে নামাজের সময়গুলো বলে দেয়া হয়েছে। সুতরাং কোরআনে ওয়াক্তের কথা নেই, এরূপ দাবির অসারতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এ আয়াতে বর্ণিত বাক্য বিশ্লেষণে পাওয়া যায়।

নামাজ কায়েম করার পর সংক্ষিপ্তভাবে নামাজের ওয়াক্ত বর্ণনা করা হয়েছে দুটি বাক্যে। প্রথমটি ‘আকিমিস্ সালাতা তারাফাইন্নাহারি’ যার অর্থ দিনের শুরু প্রান্ত। ‘তরফ’ এর শাব্দিক অর্থ প্রান্ত এবং নাহার অর্থ দিন অর্থাৎ দিনের কিছু অংশে। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, নামাজ কায়েম কর দিনের দু’প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে। দিনের দু’ প্রান্তের নামাজের মধ্যে প্রথম ভাগের নামাজ সম্পর্কে সবাই একমত যে, সেটি ফজরের নামাজ। কেননা দিন সম্পূর্ণ শেষ হওয়া মাত্র মাগরিবের নামাজ পড়া হয়। কেউ কেউ আসরের নামাজকেই দিনের শেষ নামাজ সাব্যস্ত করেছেন। কেননা, এটিই দিনের সর্বশেষ নামাজ। মাগরিবের নামাজ দিনের অংশ নয়, দিন সমাপ্ত হওয়ার পর রাতের প্রথম প্রান্তে পড়া হয়।

রাতের কিছু অংশের নামাজ সম্পর্কেও ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হযরত হাসান বসরী, মুজাহিদ, কাতাদা, যাহ্হাক প্রমুখ অধিকাংশ তফসীরকারের অভিমত হচ্ছে যে, সেটি মাগরিব ও এশারের নামাজ। হাদীসের সমর্থন পাওয়া যায়, যাতে এরশাদ হয়েছে যে, ‘যুলাফান মিনাল লাইল’। এতে মাগরিব ও এশার নামাজকে বোঝানো হয়েছে। ইবনে কাসীরের মতে, ‘তারাফাইন্নাহার’ অর্থ ফজর ও আছরের নামাজ এবং ‘যুলাফান মিনাল লাইল’ অর্থাৎ মাগরিব ও এশার নামাজ। অতএব, এ আয়াতে চার ওয়াক্ত নামাজের বর্ণনা পাওয়া গেল। অবশিষ্ট রইল জোহরের নামাজ। এর ওয়াক্ত সম্পর্কে কোরআনপাকের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আকিমিস সালাতা লিদুলুকিশ শামসি ইলা গাসাকিল লাইলি’। অর্থাৎ নামাজ কায়েম কর যখন সূর্য ঢলে পড়ে।

সূরা হুদের এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহ.) লিখেছেন যে, দিনের দু’প্রান্ত অর্থাৎ উদয়-অস্তের পূর্বে ফজর-আসরের নামাজ বুঝানো হয়েছে কিংবা একপ্রান্তে ফজর অন্য প্রান্তে মাগরিবকে রাখা বুঝানো হয়েছে। কারণ, তা একেবারে অস্ত সংলগ্ন। পূর্ববর্তীদের কারো কারো মতে, তাতে ফজর, জোহর ও আসর তিনটি নামাজ অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ দিনকে দু’ভাগে ভাগ করে প্রথম ভাগে ফজর এবং দ্বিতীয় ভাগে দুপুরে শুরু হয়ে অস্তে শেষ হয় দুই নামাজ (জোহর ও আসর) গণ্য করা হয়েছে। আর ‘রাতের কিছু অংশ’ দ্বারা কেবল এশা কিংবা মাগরিব উভয়কে বোঝানো হয়েছে। কেউ কেউ এই সম্ভাবনাও লিখেছেন যে, দিনের দু’প্রান্ত দ্বারা ফজর ও আসর এবং রাতের কিছু অংশ দ্বারা ‘তাহাজ্জুদ’কে বোঝানো হয়েছে। কেননা, ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ তিনটি নামাযই ফরজ ছিল। পরে তাহাজ্জুদের নামাজ ফরজ হিসেবে রহিত হয়ে যায় এবং বাকি দুইটিসহ তৃতীয়টি বর্ধিত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা: সূরা বনী ইসরাঈলে আল্লাহ বলেন: ‘সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে এবং কায়েম করবে ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের উপস্থিতির সময় এবং রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে। আশা করা যায় যে, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।’ আয়াত-৭৮-৭৯।

আয়াতের শুরুতে ‘লিদুলুকিশ-শামসে’ বলা হয়েছে। এ বাক্যাংশে জোহর হতে এশার সালাতের বর্ণনা রয়েছে। ‘কোরআনাল ফাজরি’-এ ফজরের সালাত পৃথকভাবে উল্লিখিত হয়েছে এর গুরুত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে। এ স্থলে ‘কোরআনের’ অর্থ সালাত বলে কোনো কোনো তফসীরবিদ উল্লেখ করেছেন। এ আয়াতেই চার ওয়াক্ত: জোহর, আসর , মাগরিব ও এশা এবং কেউ কেউ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের উল্লেখ করেছেন।

সালাত বা নামাজের সময় সম্পর্কে কোরআনের আয়াতগুলোর ভিত্তিতে ফেকার ইমামগণ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তারা বলেন যে, সূর্যের ঢলে পড়া তখনই শুরু হয়, যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে। রাত্রির অন্ধকার সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়াকে ‘গাসাকুল লাইল’ বলা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে চারটি নামাজ এসে গেছে। জোহর, আসর, মাগরিব এবং এশা। এগুলোর মধ্যে দু’নামাজের প্রথম ওয়াক্তও বলা হয়েছে যে, জোহরের প্রথম ওয়াক্ত সূর্য ঢলার পর থেকে শুরু হয় এবং এশার সময় অন্ধকার পূর্ণ হয়ে গেলে হয়। এ কারণেই ইমাম আযম আবু হানীফা (রহ.) সে সময়কে এশার ওয়াক্তের শুরু সাব্যস্ত করেছেন, যখন সূর্যাস্তের লাল আভার পর সাদা আভাও অস্তমিত হয়। এটা সবারই জানা যে, সূর্যাস্তের পর পশ্চিম দিগন্তে লাল আভা দেখা দেয়। এরপর এক প্রকার সাদা আভা দিগন্তে ছড়িয়ে থাকে। এরপর এ সাদা আভা শেষ হয়ে গেলেই রাত্রির অন্ধকার পূর্ণতা লাভ করে। তাই আয়াতের এই শব্দের মধ্যে ইমামগণ লাল আভা অস্তমিত হওয়াকে এশার ওয়াক্তের শুরু সাব্যস্ত করেছেন এবং একেই ‘গাসাকুল লাইল’ এর তফসীর স্থির করেছেন। এতে চার নামাজের বর্ণনা এসে গেছে এবং ‘কোরআনল ফাজরি’ দ্বারা পঞ্চম নামাজ অর্থাৎ ফজরের কথাও এসে গেছে। এ আয়াত এবং সূরা হুদ এর ১১৪ নং আয়াত অকাট্যরূপে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রমাণ করে।

তৃতীয় আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা: সূরা ‘ত্বাহা’য় আল্লাহ বলেন: ‘সুতরাং এরা যা বলে, সে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করুন এবং আপনার পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন রাত্রির কিছু অংশে ও দিবাভাগে, সম্ভবত: তাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।’ আয়াত-১৩০।

পরিশেষে সূরা বাকারার বিখ্যাত আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে, যাতে বলা হয়েছে: ‘সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও। বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে।’ আয়াত ২৩৮।

এ আয়াতে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত নামাজের সময় বলে দেয়া হয়েছে। মধ্যবর্তী নামাজ বলতে বিভিন্ন হাদীস অনুসারে অধিকাংশ আলেমের মতে, আসরের নামাজকে বোঝানো হয়েছে, কেননা এর একদিকে দিনের দুটি নামাজ ফজর ও জোহর এবং অপরদিকে রাতের দুটি নামাজ মাগরিব ও এশা রয়েছে। আয়াতে নামাজগুলোর সময় বা ওয়াক্তের কথা উল্লেখ করা না হলেও যেভাবে ওয়াক্তের পরিধি তথা মধ্যবর্তী বলে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে, তা চক্ষুষ্মান যে কোনো লোকের বোধগম্য হওয়ার কথা।

মোটকথা, মক্কার হঠকারী মোশরেক ও কাফেররা ঈমান থেকে গা বাঁচানোর জন্য নানা রকমের বাহানা খুঁজত এবং রসূলুল্লাহ (সা.) এর শানে অশালীন কথা-বার্তা বলত। তাঁকে কেউ জাদুকর, কেউ কবি এবং মিথ্যাবাদী বলত। কোরআন পাক তাদের এসব যন্ত্রণাদায়ক কথা-বার্তার দুটি প্রতিকার বর্ণনা করেছে।

এক. আপনি তাদের কথা-বার্তার প্রতি ভ্রক্ষেপ করবেন না, বরং সবর করবেন।

দুই. আল্লাহর এবাদতে মশগুল হয়ে যান। এতে আপনি সন্তুষ্টির জীবন-যাপন করতে পারবেন। আপনি আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা বর্ণনা করুন। তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করুন।

আয়াতে পবিত্রতা ও প্রশংসা বলতে তফসীরবিদগণের মতে, নামাজকে বোঝানো হয়েছে। এগুলোর যেসব নির্দিষ্ট সময় বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকেও তারা নামাজের সময় সাব্যস্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ-সূর্যোদয়ের পূর্বে বলে জোহর ও আসরের নামাজ এবং রাত্রের কিছু অংশ বলে রাত্রিকালীন নামাজ-মাগরিব, এশা, তাহাজ্জুদও বোঝানো হয়েছে। অতঃপর দিবাভাগ বলে এর গুরুত্ব তাকীদ করা হয়েছে।

কোরআনে নামাজের সময় বা ওয়াক্তের উল্লেখ নেই বলে যারা আপত্তি উত্থাপন করে বা সংশয় সৃষ্টি করে, তাদের উদ্দেশ্য, ইসলামের অন্যতম রোকন নামাজকে গুরুত্বহীন করা এবং ফরজ নামাজ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নফল এবাদতের দিকে নিয়ে আসা। এরূপ ধারণা, নামাজকে অস্বীকার করার শামিল। নামাজকে অস্বীকার করা মানেই ইসলামের একটি রোকনকে অস্বীকার করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
hassan ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০১ পিএম says : 0
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে এসেছেন এবং তিনি সাহাবাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেছেন সালাত নিয়ে এত লেখার কোনো দরকার নেই কেননা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেছেন যারা সালাত নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে তারা কখনও মুসলিম হতে পারে না তারা ইসলামের চির শত্রু
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন