রাজধানীতে গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপি তার বিভাগীয় গণসমাবেশের অংশ হিসেবে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে কিছুতেই সমাবেশ করতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সরকার কেন সেখানে সমাবেশ করতে না দিয়ে হার্ডলাইনে গিয়েছিল, তা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। অথচ বিএনপি আগেও তার কার্যালয়ের সামনে বড় ধরনের সমাবেশ করেছে। সেগুলো নিয়ে সরকার এতো মাথা ঘামায়নি, বাধাও দেয়নি। এটিই কেন সরকারের কাছে বিশেষ কিছু হয়ে উঠল? এর কিছু জবাব ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরোক্ষভাবে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিএনপি তার কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশের নামে লাখ লাখ নেতাকর্মী জড়ো করে অবস্থান নিয়ে নেবে। এতে সরকার সমস্যায় পড়বে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এমন আশঙ্কা থেকেই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেছেন, হেফাজতকে শাপলা চত্বরে যেভাবে দমন করা হয়েছিল বিএনপিকেও একইভাবে দমন করা হবে। এই আশঙ্কা থেকেই বিএনপিকে তার কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। সেখানে যাতে সমাবেশ করতে না পারে এজন্য পুরো পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহারের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল। তার এই মনোভাব থেকে বোঝা যায়, সরকারের মধ্যে ক্ষমতা হারানোর এক ধরনের ভীতি কাজ করেছে। এতটাই ভীতি কাজ করেছে যে, বিএনপির শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার করেছে, এমনকি মহাসচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকেও গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। এমন এক বিরূপ পরিস্থিতিতে বিএনপি সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে গোলাপবাগে সমাবেশ করেছে। শত বাধাবিঘ্ন পার হয়েও সমাবেশে বিপুল মানুষ উপস্থিত হয়েছে। বিএনপি গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে অনেক আগে থেকেই বলেছে, এটি অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতোই একটি সমাবেশ হবে এবং এ সমাবেশ থেকে পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করা হবে। হয়েছেও তাই। ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাজধানীতে জনদুর্ভোগের কারণ দেখিয়ে সরকার বিএনপিকে তার কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের যে অনুমতি দেয়নি, দেখা গেছে, ১০ ডিসেম্বর সরকারই বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে দিয়ে রাজধানীকে অবরুদ্ধ এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। এর কয়েক দিন আগেও ক্ষমতাসীন দল যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাধিক সমাবেশ করেছে, তখনও বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল। সে ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বহু আগে থেকেই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল, বিএনপিকে যদি আন্দোলন-সংগ্রাম করার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তার ক্ষমতা প্রলম্বিত হবে না। এ কারণে, ক্ষমতায় আসার পরপরই বিএনপিকে কোনঠাসা করার নীতি অবলম্বন করে। দমন-পীড়ন এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা করে সংকুচিত করে ফেলে। রাজনীতির মাঠে নামতে দেয়নি। এর বিপরীতে ক্ষমতাসীন দল থেকে অহরহ বলা হয়েছে, বিএনপি’র আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই। এটি অনেকটা চাণক্যনীতির মতো। বিএনপিকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতো পরিস্থিতিতে ফেলে বলেছে, তার আন্দোলন করার মুরোদ নেই। এ নিয়ে সরকার নানা সমালোচনার মুখে পড়লেও তা আমলে নেয়নি। ফলে পর্যবেক্ষকসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা সরকারকে কর্তৃত্ববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিগত কয়েক মাসে সরকার বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে। তাও আবার নানা শর্ত এবং বাধা দেয়ার মধ্য দিয়ে। এটুকু করতে দিচ্ছে এ কারণে যে, সময়টা বদলেছে। দেশ-বিদেশে সরকারের এমন আচরণ এখন গ্রহণ করা হচ্ছে না। সরকারের ওপর চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকার বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে। এর মধ্যেই নানা গুজব-গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে।
দুই.
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে, সেটা যে ক্ষমতা হারানোর ভয় তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হারানোর ভয় থাকে না। তার ক্ষমতা দিনের আলোর মতো। তাকে অন্ধকার গ্রাস করে না। মুখে যত কথাই বলুক, ক্ষমতাসীন দল যে গ্রহণযোগ্য ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়নি তা সে ভালো করেই জানে। তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল। যদি এমন হতো ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিনাভোটে ১৫৩টি আসনে নির্বাচিত না হতো কিংবা ২০১৮ সালের রাতের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় না আসত, তাহলে এ নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছু থাকত না। কে ক্ষমতায় যেতে চায় বা ষড়যন্ত্র করছে, এ নিয়ে অনুমাননির্ভর ও অসার কথাবার্তার প্রয়োজন পড়ত না। এখন নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন দলের ভেতর এক ধরনের নার্ভাসনেস যে কাজ করছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ নার্ভাসনেসের দুটি দিক হচ্ছে, এক. সুষ্ঠু নির্বাচন হলে হেরে যাওয়ার ভয়। দুই. নার্ভাসনেস কাটাতে সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর হয়ে উঠা। তবে সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, সে খুবই শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। যে কোনো উপায়ে বিরোধী রাজনীতিকে দমন করে যেনতেনভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। কারণ, সরকার নিশ্চিত জানে, সে যেভাবে প্রশাসন সাজিয়েছো, ক্ষমতায় থাকার জন্য তাই যথেষ্ট। অর্থাৎ মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও নেপথ্যে পুরোপুরি প্রশাসন নির্ভর। এ কারণেই, এখন সংবিধান সংশোধণ ও সংস্কার এবং জাতীয় সরকারের দাবি তোলা হচ্ছে। সাজানো প্রশাসন দিয়ে যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, তা বোধকরি ক্ষমতাসীন দলের একজন কর্মীও জানে। অবশ্য আগামী নির্বাচন যে তার জন্য সহজ হবে না, তা তারাও জানে। কারণ পরিস্থিতি বদলেছে। দেশ ও আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চাইলেই আর আগের দুই নির্বাচনের মতো নির্বাচন করা যাবে না।
তিন.
বিএনপির পক্ষ থেকে এখন বারবারই বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন আর আগের মতো হতে দেয়া হবে না। দলটি কেন এবং কিসের ভিত্তিতে এ কথা বলছে, তা স্পষ্ট নয়। একটি সরল হিসাব হতে পারে, বিএনপি প্রবল আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলবে। তবে এটা কিভাবে সম্ভব, তা এখনও পরিস্কার নয়। কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যেমন সরকারে থেকে শক্তিশালী, তেমনি মাঠেও শক্তিশালী। এই দুই শক্তির মোকাবেলা করে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ কাজ নয়। এখানে একটি উপায়ই হতে পারে, যদি প্রশাসন তার নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে। এ চিন্তা করা এখন অসম্ভব। যে প্রশাসনকে সরকার দলীয়করণ করা থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, সে প্রশাসন কেন নিরপেক্ষ অবস্থানে যাবে কিংবা সরকারের খুঁটি হবে না? সরকারের জোরটি এখানেই। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আরেকটি নির্বাচন করবে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কি আরেকটি নির্বাচন করা সম্ভব? বিশেষ করে যখন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বিদেশী রাষ্ট্রগুলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অনেক বেশি সরব, তখন এ চাপ সরকার কি সামলাতে পারবে? এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক তীব্র সংকটের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা কতটা সহ্য করতে পারবে? কারণ, সরকার বহু নিপীড়ন-নির্যাতন করেও তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে নিঃশেষ করতে পারেনি। দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যেও পরিবর্তনের একটি হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সরকারের খুঁটির জোর যে ভারত, তার অবস্থানও আগের মতো আছে, এমনটি মনে করার কারণ নেই। ৫ জানুয়ারির মতো সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আরেকটি নির্বাচন করিয়ে দেয়ার মতো অপরিপক্ক কাজ দ্বিতীয়বার সে করবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে ভারত বলেছে, সে চায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হোক। এবার যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বেশ সরব, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠনের আগে। এ প্রেক্ষিতে, যদি রাজনৈতিক সমঝোতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি না হয় বা রাজনৈতিক দলগুলো তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে দেশ নতুন করে বড় ধরনের সংকটে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
চার.
আপাত দৃষ্টিতে দেশের সার্বিক রাজনীতি স্থিতিশীল মনে হলেও, তা যে নির্বাচন পর্যন্ত থাকবে, এমন মনে করার কারণ নেই। দেশের অর্থনৈতিক সংকট এবং নানা ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে এক ধরনের অস্বস্তি ও অস্থিরতা রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ এবং অন্যান্য বিরোধীদলের যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা ক্ষমতাসীন দলের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে আগের মতো উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিএনপিকে যতই উপেক্ষা ও পাত্তা না দেয়া হোক, তার চলমান জনসম্পৃক্ত আন্দোলন নিশ্চিহ্ন করে দেয়া সম্ভব নয়। দলটির বক্তব্য দেশের মানুষের কাছে পৌঁছছে। তারা শুনছে, চিন্তা করছে। এটা যে আওয়ামী লীগ বোঝে না, তাও নয়। এজন্যই তাকে বলতে শোনা যায়, বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি দলের নানা উসকানি সত্ত্বেও বিএনপি সহনশীল হয়ে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করছে। এটাও ক্ষমতাসীন দলের জন্য অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির এই ইতিবাচক মনোভাব ক্ষমতাসীন দলের বিপরীতে এবং বিএনপির অনুকূলে যাচ্ছে। বিএনপিকে দিয়ে কিছু হবে না, হতাশ হওয়া সাধারণ মানুষের এ মনোভাবের বিপরীতে দলটির অবস্থান ধীরে ধীরে সুসংহত হওয়ার প্রচ্ছন্ন একটা দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভেতরে ভেতরে দলটি নিজেকে আন্দোলনের জন্য তৈরি করেছে। এর বিপরীতে ক্ষমতাসীন দল দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন নির্ভর হয়ে রয়েছে। ক্ষমতার বাইরে তার রাজনৈতিক শক্তি কতটা অটুট, তা বলা মুশকিল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার প্রকৃত শক্তি ও সক্ষমতা বোঝা যাবে। পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, ক্ষমতা থেকে চলে গেলে দলটির রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। এখন ক্ষমতায় থাকায় তা টের পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতায় মোহগ্রস্ত হয়েই প্রতিপক্ষকে আমলে নিচ্ছে না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বৈরিতা বৃদ্ধি করে চলেছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এ বৈরিতা ও সংঘাত যে বৃদ্ধি পাবে, তাতে সন্দেহ নেই।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন