বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নির্বাচন নিয়ে দু’ পক্ষের সমঝোতায় আসা জরুরি

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:৫৪ এএম

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও নির্বাচন বিষয়ে পাকিস্তানি ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, কেউ বিরোধী দলের মতামত নিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। ভিন্নমতের প্রতি সাধারণ সহিষ্ণতাটুকু দেখাতে কেউ রাজি হয়নি। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি অন্যদের নিয়ে আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি ও অন্যান্য দল একই দাবিতে আন্দোলন করছে।

গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটের রাজনীতি বা ভোটের সময় মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে ঘোরা, হাত-পা ধরা নয়! গণতন্ত্র হলো, গণমানুষ তথা সাধারণ মানুষের কথা বলা, জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জবাবদিহিতা আছে কী? জবাবদিহি থাকলে দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরিচামারি, লুটপাট চলতে পারে না। বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে সত্যিই অগ্রগতি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। দেশের জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, এই বিষয়ে ফেয়ার কোনো পদ্ধতি আজও কার্যকর হয়নি। এ দায় কারো একার নয়। এ দায় সমানভাবে বর্তায় জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি বক্তব্য দিচ্ছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে আগামী নির্বাচন থেকে শুধু দূরেই থাকবে না, ওই নির্বাচন হতেও দেবে না। এ দেশের ইতিহাস হলো, যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যস্ত থাকে। তবে সবারই লক্ষ্য নির্বাচন। নির্বাচনের বৈতরণী পার হলেই পোয়াবারো। আমাদের দেশের রাজনীতি মূলত দোষারোপের রাজনীতির আবর্তে আবর্তিত।

বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আবার যদি নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনো সংকট তৈরি হয়, তাহলে এই মুহূর্তে সেই ঝামেলা সামাল দেওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের পরিণতি হবে শ্রীলংকা থেকেও ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ যদি একতরফা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয় এবং বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে, কী পরিস্থিতি হবে? কারো হাতে ৫০০ টাকার নোট গুজে দিয়ে, এক বোতল পেট্রোল ধরিয়ে দিয়ে বললেই হয় ‘আগুন দিয়ে ঐ বাসে ছুড়ে আয়’। তাতেই কাজ হয়ে যাবে। শ্রীলংকায় যা হয়েছে তাতে কেউই জয়ী হয়নি। রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে। আগের অবস্থায় আসতে তাদের অনেক অনেক দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। আজ দেশে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়, বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে ব্যাংক দিতে পারবে না। রেমিট্যান্সের প্রভাবও ইতোমধ্যে পড়েছে। রফতানি ও প্রবাসী আয় হ্রাসের কারণে সরকার বেকায়দায় আছে। তাই নিজ দেশের ক্ষতি ও ধ্বংস করতে উৎসাহ ও রিউমার ছড়ানো উচিত নয় কারো। বর্তমানে অসহ্য বাজারদর; বিশেষ করে চাল, ডাল, তেলের দামে মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বিদ্যুৎ-সংকট, জ্বালানিসংকট, মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, মানুষের মেজাজ ঠিক নেই। বৈষম্য আর দারিদ্র্যও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড নিচে নেমে এসেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, উচ্চ ঋণ নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ শ্রীলংকা না হোক, নির্বাচন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘটলে তা সামাল দেওয়া, সংঘাত সংকটের ভার বহন করার সক্ষমতা আমাদের নেই। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যদিনের খরচের বোঝা মানুষজন আর টানতে পারছে না। এসব কারণে সাধারণের উপস্থিতি বিএনপির মিছিলে বাড়ছে।

এর আগে সিইসি মাঠ ছেড়ে না দিয়ে তলোয়ারের বিরুদ্ধে তলোয়ার বা রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। পরে যদিও সিইসি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি তলোয়ার ও রাইফেলের প্রসঙ্গটি বলেছেন কৌতুক করে। সিইসির এই বক্তব্যে যে নির্মম সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো, নির্বাচনের নামে দেশে শক্তি পরীক্ষার মহড়া হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কৌতুক করে বললেও মাঠে কিন্তু ঢাল-তলোয়ারের খেলা শুরু হয়ে গেছে। সিইসি যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চান, প্রথমে তাদের কর্তব্য হবে নির্বাচনী মাঠকে তলোয়ারমুক্ত করা। ইতিপূর্বে বিএনপিকে ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক সন্ত্রাস ও হানাহানি ঘটেছে।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তার পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই এক/এগারোর পটপরিবর্তন ঘটে। বিরোধী দলের আন্দোলন, কূটনীতিকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে বিএনপি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে একটি জবরদস্তির নির্বাচন করতে গিয়ে যে ভুল করেছিল, নেতারা এখন তা স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ যদি আবারও দেশবাসীর ওপর জবরদস্তির নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চায়, তার পরিণতি কী হবে সৃষ্টিকর্তাই জানেন। অনেকে বলেন, ক্ষমতা ছাড়লেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় আটক হবেন ক্ষমতাসীনরা। তাই আমৃত্যু ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা জারি রাখবেন। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই কথা বলত। সে সময়ে আওয়ামী লীগের দাবি যদি যৌক্তিক হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগও এখন সেই দাবিকে অযৌক্তিক ও অসাড় প্রমাণ করবে কীভাবে?

এরশাদ সরকারের পতনের পর তথা ১৯৯০ সালের পর থেকে যত সরকারই এসেছে, যে দৃশ্য বারবার দেখা গেছে তা হলো, বিদেশিদের কাছে ধর্না দেওয়া। অতীতে দেখা গেছে, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা বিরোধী দলের ন্যায্য দাবিও আমলে নেন না। ফলে বিরোধী দল হরতাল, আন্দোলনের নামে জান-মালের হানি, গণমাধ্যমে দেশবাসীকে তাদের দাবিদাওয়ার কথা জানানো, সর্বশেষ বিদেশিদের কাছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে দাবি মানতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আমরা বলতে চাই, কেন বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায় সে বিষয়টিও ভাবা দরকার। আওয়ামী লীগের ভুলে যাবার কথা নয়, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সদলবলে কতবার বৈঠক করেছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, কানাডার হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসন, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, এমনকি তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, মিসর, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। সরকারের আচরণ এমন হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়, যাতে বিরোধীদের অসহায় হয়ে ভিনদেশিদের কাছে সাহায্য চাইতে হয়। এটা কেবল সরকারের জন্য লজ্জার নয়, সরকারের ব্যর্থতাকেও স্পষ্ট করে। এটা ঠিক যে, দেশের নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধর্না দেওয়া যতটা অমর্যাদার, তার চেয়ে বেশি লজ্জার সুষ্ঠু নির্বাচন না করার ক্ষেত্র তৈরি করা। দল-মত নির্বিশেষে অতীতের সকল অজ্ঞতা ও দুর্বলতা এবং ভুলগুলো ভুলে গিয়ে আমাদের দেশ গঠনে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীই একটা বিপদের সম্মুখীন। আমরা নিজেরা যদি দলাদলি করতে থাকি, হিংসার আগুনে জ্বলতে এবং জ্বালাতে থাকি, তাহলে আখেরে ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন