‘মানবাধিকার’ শব্দটি গোটা বিশ্বে বহুল আলোচিত। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণয়ন করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সনদ। এসব রাষ্ট্র দ্বারাই আবার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা এসব করেন। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠন করা হয়েছিল League of Nations। ব্যর্থ হওয়ার পর এর অপমৃত্যু ঘটে। সংগঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গঠিত হয় United Nation, বাংলায় যা জাতিসঙ্ঘ হিসেবে পরিচিত। সর্বস্তরের মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য তথা নারী, পুরুষ, শিশু, নৃ-জাতি, রিফিউজি, ঘড়-গধহং খধহফ এর অধিবাসী, রাষ্ট্রবিহীন অধিবাসী, পঙ্গু, অবহেলিত, সব মানুষের অধিকার রক্ষার্থে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে মানবাধিকার সনদ অনুমোদন হয়েছে। যেসব অধিকার কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সনদ থেকে বাদ পড়েছে সেগুলোকে পূর্ণ করেছে আন্তর্জাতিক প্রোটোকল। তারপরও সর্বস্তরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? সঙ্ঘাত বাড়ছে, দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার বাড়ছে। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমানতালে ঘটে চলছে।
জাতিসঙ্ঘ ছাড়াও প্রতিটি মহাদেশে মানবাধিকার রক্ষার জন্য গঠিত হয়েছে আঞ্চলিক সংগঠন। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয় করে ১৯৪৯ সালে লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় Council of Europe, যার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করা। ইউরোপের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক সমন্বয় বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৫৬ সালে রোম চুক্তির মাধ্যমে গঠন করে European Union। ১৯৫০ সালে ড়ভ Europe আঞ্চলিক সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের জন্য ২৪টি অধিকার নিশ্চিত করে, যা বাস্তবায়ন ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চার স্তরের আদালত রয়েছে যা নিম্নবর্ণিত নামে পরিচিত যথা- ১. দি কমিটি, ২. দি চেম্বার, ৩. গ্রান্ড চেম্বার ও ৪. কমিটি অব মিনিস্টার্স। এ ছাড়াও রয়েছে European Social Charter। এসব সংগঠনের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা দেয়া।
অনুরূপভাবে আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মানবাধিকার উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য ১৮৯০ সালে গঠিত হয়েছিল International Union of American Republic। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় Orgainisation of American States। পরে ১৯৬৯ সালে Inter American Convention on Human Rights নামক আঞ্চলিক সম্মেলনের মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য ২৬টি অধিকার নিশ্চিত করে যা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার প্রতিকারের জন্য নিজস্ব আদালত রয়েছে, যা American Court of Human Right নামে পরিচিত। ওই আদালত মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে রাষ্ট্রকে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
অনুরূপ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মানবাধিকার রক্ষার জন্য ১৯৮১ সালে গঠিত হয় African Charter on Human and Peoples Rights, যা পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে African Union নামে নামকরণ করা হয়। ওই Union এর মাধ্যমে গঠিত হয় Inter African Court of Human Rights, যার দায়িত্ব নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করাসহ রাষ্ট্রকে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান।
এশিয়া মহাদেশের রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের মধ্যে অনুরূপভাবে মানবাধিকার রক্ষা ও সমন্বয় করার জন্য ১৯৬৭ সালে গঠিত হয় Asean। কিন্তু অন্যান্য মহাদেশের মতো অংবধহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য ‘মানবাধিকার রক্ষা আদালত’ গঠিত হয়নি। ফলে রাষ্ট্রদ্বারা নাগরিকদের মানবাধিকার খর্ব করার কারণে মানবাধিকার রক্ষা আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না। যেমনটি মানবাধিকার আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেনি ভারতের মুসলমান গোষ্ঠী এবং মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা। উল্লেখ্য, গত ১৬ নভেম্বর গণমাধ্যমে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের সর্ব উত্তরের আচেহ প্রদেশের উপকূলে নারী, শিশুসহ ১১১ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে হাজির হয়েছে একটি নৌকা। মিয়ানমারের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশত্যাগ করে, এটি তার সর্বশেষ নজির। বছরের পর বছর ধরে নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে সমুদ্র যখন তুলনামূলক শান্ত থাকে তখন মিয়ানমারের নির্যাতিত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের দলে দলে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার দিকে নৌকা ছোটাতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা আচেহতে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে, অনেককে মাসের পর মাস সমুদ্রেও কাটাতে হচ্ছে। মিয়ানমারের জন্ম হলেও দেশটি রোহিঙ্গাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ শরণার্থী বিবেচনা করে। উত্তর আচেহ সরকারের মুখপাত্র হামদানি বলেছেন, ২৭ নারী ও ১৮ শিশুসহ যে ১১১ জন ইন্দোনেশিয়ায় পা রেখেছে, তারা সবাই সুস্থ আছে। তারা ইতোমধ্যে (নৌকা থেকে) নেমেও গেছে। তাদের সেবা শুশ্রুষা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হামদানি।
ইন্দোনেশিয়ার অনেকের মতো তার নামও কেবল এক শব্দের। তিনি জানান, এ রোহিঙ্গারা এখন কাছাকাছি একটি গ্রামে অবস্থান করছে। এদের নিয়ে কী করা হবে, তা ঠিক করতে কর্তৃপক্ষ বৈঠকে বসবে। ২০১৭ সালে সামরিক দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর সাত লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যায়। ওই দমন-পীড়ন চলাকালে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল বলে ভাষ্য প্রত্যক্ষদর্শীদের। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মিয়ানমারে সেনা নিপীড়নে হতাহত বেসামরিক নাগরিক ও জ্বালিয়ে দেয়া ঘরবাড়ির হিসাব রাখছে।’ মুসলমান রোহিঙ্গারা এত নির্যাতনের পরও মানবাধিকার আদালতের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত।
আন্তর্জাতিক আঞ্চলিক মানবাধিকার সংগঠন ও আদালত ছাড়া পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে সাংবিধানিক বিধিবিধান বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও আদালত রয়েছে। অনুরূপ বাংলাদেশে মানবাধিকার আদালত গঠিত না হলেও ২০০৯ The National Human Rights Commission Act ২০০৯ এর অধীনে গঠিত হয় ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’। যা ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ থেকে কার্যকারিতা শুরু করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সম্পাদিত, প্রণীত ও অনুমোদিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে দেশের সব নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৪ পর্যন্ত নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়নের মাপকাঠি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০০৮ সালে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গঠিত হয় যা ২০০৯ সালে আইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ওই আইনে মানবাধিকার রক্ষা আদালত গঠন করার কোনো প্রভিশন রাখা হয়নি অথবা ক্ষতিপূরণ আদায়-সংক্রান্ত কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তবে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক অধিকার আদায় ও অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন কোনো রিট মামলায় তদন্ত ও প্রতিবেদন পেশ করার জন্য ওই আইনের ১৩ ধারা মোতাবেক জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিচারিক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
ওই আইনের ১২ ধারা মোতাবেক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বউদ্যোগে তদন্ত করার ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে জেলখানাসহ যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এমন স্থান যথা সংশোধনাগার, হাজতখানা বা যেখানে আইনদ্বারা কাউকে অবরুদ্ধ রাখা হয় সেসব স্থান পরিদর্শনের অধিকার কমিশনের রয়েছে। অনেক নির্দোষ মানুষ কারাগারে বন্দী রয়েছে দীর্ঘদিন, সম্পত্তির লোভে কূটকৌশলে অনেক মানুষ আত্মীয় স্বজনদের ষড়যন্ত্রে পাগলাগারদে আটকে আছে, রিমান্ডের নামে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটছে অনেক মানুষের, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে কারাগারে মৃত্যুবরণ করছে অনেক বন্দী, কিন্তু আজ পর্যন্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ক’জন নির্যাতিত মানুষকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করেছে? তা ছাড়া সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিকারের জন্য আদৌ কোনো নির্দেশনা দিয়েছে কি তারা?
রাষ্ট্র কর্তৃক দায়িত্ব অবহেলা ও অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনীহা এবং ব্যর্থতা নিরূপণের জন্য সংবিধানের ৭৭নং অনুচ্ছেদে ‘ন্যায়পাল’ নামক একটি পদ-পদবি রয়েছে, কিন্তু ‘ন্যায়পাল’ নামে পদের কার্যক্রম শুরু হয়নি। ‘ন্যায়পাল’ সম্পর্কে সংবিধানে যা বলা হয়েছে:
১. সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন।
২. সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন।
৩. ন্যায়পাল তাহার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে বার্ষিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হবে।
‘মানবাধিকার’ একটি বুলিতে পরিণত হয়েছে, যেমনটি ‘গণতন্ত্র’ নামক শব্দটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হচ্ছে গণতন্ত্রের নাম দিয়ে। মানবাধিকার হরণ করা হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার নামে। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধই মানবাধিকারের প্রথম শর্ত। মানবাধিকার আইন ও আন্তর্জাতিক সনদ রয়েছে, অধিকন্তু রয়েছে নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধান, যা রাষ্ট্রের জন্য অনুকরণীয় একটি জীবন্ত দলিল। রাষ্ট্রের ইচ্ছায় সে দলিল সর্বক্ষেত্রে কার্যকর নয়। একটি শক্তিশালী স্বয়ংসম্পূর্ণ বিচারিক ব্যবস্থাই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন