শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে

শাহাদাত আনসারী | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

অনেক অপেক্ষার পর গত ১৪ ডিসেম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ৩৭ হাজার ৫৭৪ জনকে সহকারী শিক্ষক পদে নির্বাচন করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মেধাবী বেকার তরুণরা যেমন তাদের প্রতীক্ষার প্রহর শেষ করলেন, ঠিক তেমনি প্রথমিক শিক্ষা পরিবার পেলেন ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগরদের। সর্বোপরি দেশ পেলো জাতি গড়ার এক ঝাঁক মানুষ। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমেই শিশুদের মেধা ও মননশীলতার বিকাশ ঘটে। তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা সবার আগে। বর্তমান সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি ভালোভাবে নজর দিচ্ছেন। বিশেষ করে, সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে যা করার তা সুপরিকল্পিভাবে করা হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষক ঘাটতি পূরণের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দ্রুতকরণ তারই একটা অংশ।

পাশের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্তমানে ঝরেপড়া শিক্ষার্থী কমেছে। শিশুরা এখন কাজের সন্ধান না করে বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং শিক্ষার মান উন্নতকরণের জন্য শিশুরা এখন আনন্দের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে। শিক্ষকরাও মানসম্মত শিক্ষাদানে বদ্ধপরিকর। একজন শিক্ষক ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে পাঠ উপস্থাপন করে শিশুদের পড়ায় আকৃষ্ট করছেন। নব নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণের সবাই স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রীধারী। তাঁরা নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। মেধাবীরা এখন শিক্ষকতায় এগিয়ে আসছেন। কিন্তু যেখানে অষ্টম শ্রেণি পাশ করা ড্রাইভার বা এইচএসসি পাশ কম্পউটার অপারেটর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে বেতন- ভাতাদির সুবিধা বেশি পান সেখানেই শিক্ষকতা পেশাকে অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। বেতনটাও আজ সমাজে একটা বৈষম্য তৈরি করে। তাই শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অন্তর্ভুক্ত করতে বেতন ও গ্রেড বৃদ্ধির দিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। আবার প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (পিটিআই) এ দীর্ঘমেয়াদী ডিপিএড বা সি-ইন-এড কোর্স সম্পন্ন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পেশাদারী মনোভাব গড়ে তোলেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় কারিকুলাম বা শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে শিক্ষকরা সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেন না। শিক্ষাদান পদ্ধতি সুষ্ঠুভাবে নির্ধারিত হলে এবং শিক্ষকরা এটা আয়ত্ত করতে পারলে বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যথায় খরচ ও সময়ের অপচয় হলেও শিক্ষাদানের সঠিক পদ্ধতির অভাবে মানসম্মত শিক্ষার লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা বেশিরভাগই বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেছেন। পঠিত বিষয়ে জ্ঞান থাকলেও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। এক্ষেত্রে নবাগত শিক্ষকদের পিটিআই বা ইউআরসিতে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যেন নিজেদের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন এজন্য তাদের সাথে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আচরণ ইতিবাচক হওয়া দরকার। তাদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এর শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পাঠদানে দক্ষ করতে হবে। অনেক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হীনমন্যতায় ভোগেন। নিজেদেরকে ছোট ভাবেন। কিন্তু তাঁদেরকে বুঝতে হবে দেশ ও জাতি গড়তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে কেউ বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন না।

শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে পদায়ন নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেন। সবার পদায়ন যেন নিজ এলাকায় হয় সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া দরকার। বিশেষ করে নারী শিক্ষকদের দুর্গম এলাকায় পদায়িত না করে শহরকেন্দ্রিক বা পছন্দের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুযোগ দেয়া যেতে পারে। চর এলাকায় একজন শিক্ষক নিয়েই অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলছে। কিন্তু শহর এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে ঠিকই শিক্ষক ঘাটতি নাই। নব নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চরাঞ্চলে না দিয়ে প্রথমে তাঁদের সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। পেশার প্রতি তাঁরা যেন গুরুত্ব দেন এবং নিজের কাজকে বড় করে দেখেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে যেন কোনো ধরনের অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে না হয় তা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, প্রথমেই যদি শিক্ষকদের বেতন-ভাতাদির ব্যবস্থা করতে ঘুষ দিতে হয় তখন তাদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব গড়ে উঠবে। নতুন ব্যাংক হিসাব খুলতে যেন অতিরিক্ত টাকা গুনতে না হয় তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তথা শাখা ব্যবস্থাপককে নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাঁদের অনেকেই ভালো বেতন বা উচ্চতর গ্রেডে চাকরি পেলে সহজেই চলে যান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রায় তিন-চার বছর লেগে থাকে। সুযোগ পেয়ে যখন নব নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চলে যান তখন পুনরায় শিক্ষক ঘাটতি দেখা যায়। তাই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্যানেলের ব্যবস্থা থাকলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব বলে অনেকেই মত দিচ্ছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি নাই বললেই চলে। পদোন্নতি পেয়ে সর্বোচ্চ প্রধান শিক্ষক হতে পারেন। তাও আবার হাতেগোনা কয়েকজন। যেকোন চাকরিতে পদোন্ননতি না থাকলে পেশাদারি মনোভাব যেমন গড়ে উঠে না ঠিক তেমনি কাজ বা পেশার প্রতি আগ্রহও থাকে না। তাই সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে প্রধান শিক্ষক বা সহকারি থানা শিক্ষা অফিসার পদে আবেদনের সুযোগ দিয়ে মেধার মূল্যায়ন করতে হবে। এমনটা না হলে নব নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারি শিক্ষকরা শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবেন।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষ) এর ১৭টি লক্ষ্যের অন্যতম লক্ষ্য ‘সকলের জন্য নায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ’। বাংলাদেশ এ লক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করে মানসম্মত শিক্ষা (ছঁধষরঃু ঊফঁপধঃরড়হ) নিশ্চিতকরণের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে তরুণ শিক্ষকদের বেশি প্রয়োজন। কারণ তাঁরা মাল্টিমিডিয়া মাধ্যম ব্যবহার করে সহজ এবং আকর্ষণীয় পাঠ উপস্থাপন করতে পারেন। নব নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করে তুলনামূলক সুবিধা ও উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে দেশ এগিয়ে যাবে। তাঁরা যেন নিজ পেশায় আগ্রহী হন এবং শিশুদের পাঠদানে যত্নবান হন তা নিশ্চিত করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষা গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন