বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের টাকা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের দক্ষতা নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের। এমনকি প্রকল্প নেয়া হলেও তা সময় মতো শুরু করা নিয়েই তৈরি হয় জটিলতা। ফলে, শেষ হতেও সময় বেশি লাগে কয়েকগুণ পর্যন্ত। আর তাই বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষতার অভাবে যে দেরি হয় সে কারণে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের অনুমোদিত ২০০ কোটি ডলার নমনীয় বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দেশ যখন ডলার সঙ্কট নিমজ্জিত, তার মধ্যে এই বিলম্বের ফলে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
সূত্র মতে, হায়ার এডুকেশন এক্সেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (শেড) প্রকল্পে ১৯১ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক; ৩৫৮ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে সড়ক ও নিরাপত্তা প্রকল্পে। এছাড়া, এক্সেলেরেটিং ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেড কানেক্টিভিটি ইন ইস্টার্ন সাউথ এশিয়াÑবাংলাদেশ ফেজ-১ (অ্যাক্সেস) প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছে ৭৫৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার। রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর এডাপশন অ্যান্ড ভালনারেবেলেটি রিডাকশন (রিভার) প্রকল্পে ৫০০ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশ এনভায়রোমেন্টাল সাসটেইনেবেলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফর্মেশন (বেস্ট) প্রকল্পে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন দিয়েছে। ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকল্পগুলো অনুমোদন লাভ করে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) সভায় অনুমোদনের পরই উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে বৈদেশিক ঋণ চুক্তি করা হয়। আর ঋণ চুক্তি সইয়ের পরই ঋণ কার্যকর করা হয়।
প্রায় সব প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয় চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন/পুনর্গঠনে দেরির কারণে সেসব একনেকে উপস্থাপন করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি চার প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রকল্প প্রস্তাবের কোনো কোনো জায়গায় সংশোধন করতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে এখনো পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, একটি মাত্র প্রকল্পে সব প্রক্রিয়া শেষ করে এখন একনেকে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মো. মামুন- আল- রশিদ বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি তহবিলের অর্থায়নের প্রকল্পে ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে। কিন্তু, ডলারের সরবরাহ বাড়াতে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছে পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু, কমিশনের দেয়া পর্যবেক্ষণ অনুসারে মন্ত্রণালয়গুলো সময়মতো পুনর্গঠিত ডিপিপি দিতে পারছে না বলে দেরি হচ্ছে। প্রায় ১০ মাস আগে পিইসি সভা হয় ‘সড়ক ও নিরাপত্তা’ প্রকল্পের। ২৫ এপ্রিলে হয় শেষ প্রকল্পের। অন্যদিকে, অ্যাক্সেস প্রকল্পের প্রথম পিইসি সভায় হয় ১৮ মে এবং রিভার প্রকল্পের ১২ জুলাই, ২০২২ তারিখে।
সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশ এনভায়রোমেন্টাল সাসটেইনেবেলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফর্মেশন (বেস্ট) প্রকল্পের পিইসি সভায় হয় চলতি অর্থবছরের ১১ মে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, সরকার বিশ্ব পরিস্থিতি ও ডলার সঙ্কট বিবেচনায় বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে গুরুত্ব দিলেও, প্রস্তুতি না থাকায় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা যাচ্ছে না। কোনো প্রকল্পের ঋণ চুক্তি যদি এক বছর পর হয়, তাহলে অর্থছাড়ও পিছিয়ে যাবে। এতে ভবিষ্যতে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইআরডির তথ্যমতে, জুলাই-অক্টোবর মেয়াদে বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি ৮৫ শতাংশ কমে ৪১৩ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার হয়েছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২৭৬ কোটি ডলার। ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরই উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থছাড় হয় না। এটা প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরও নির্ভর করে। এক থেকে তিন বছরে সাধারণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। বৈদেশিক অর্থায়নের অর্থছাড়ের বছর-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা থাকে। সাধারণ অবকাঠোমো নির্মাণের প্রকল্পে প্রথম দুই অর্থবছরে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়। ক্রয় কাজের প্রকল্পে প্রথম দুই বছর ৪০ শতাংশ অর্থও ছাড় হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের আইডিএ-২০ ঋণ তহবিল থেকে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদহারে এসব প্রকল্পে ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এছাড়া, ঋণের সার্ভিস চার্জ শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ঋণের শর্ত যে কোনো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর চেয়ে সর্বনিম্ন।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, আইডিএ-২০ এর আওতায় আগামী তিন বছরে (জুলাই ১, ২০২২ হতে ৩০ জুন, ২০২৫ পর্যন্ত) আইডিএভুক্ত দেশগুলোকে ৯৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক। তিন বছরের আইডিএ-২৯ এর শুরুতে বাংলাদেশ যদি বেশি প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে, সেক্ষেত্রে শেষের দিকে ঋণের সুযোগ বেড়ে যাবে। অনেক দেশই আইডিএ প্যাকেজে তাদের জন্য বরাদ্দের পুরোটা নিতে পারে না। আর এই অব্যবহৃত অর্থ বিশ্বব্যাংক অন্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিতরণ করে। আগের আইডিএ প্যাকেজগুলোতে এই সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কোনো প্রকল্পের ঋণ চুক্তি যদি এক বছর পর হয়, তাহলে ওই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও অর্থছাড়ও পিছিয়ে যায়। এতে সময়মতো প্রকল্পের সুফল ভোগ করা যাবে না।
উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি তহবিলের টাকা কম ব্যয় করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তিতে জোর দিতে হবে। তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে ডলার বা বৈদেশিক অর্থ সহায়তা ব্যয় করা না গেলে, সামনে আরও জটিল পরিস্থিতিতে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। যে পাঁচ প্রকল্পে সরকার অর্থায়ন চেয়েছে, বিশ্বব্যাংক বোর্ড তাতে সম্মতি জানিয়েছে। কিন্তু, অনুমোদন ছাড়া এসব ঋণ ব্যবহার করা যায় না বলে উল্লেখ করেন জাহিদ হোসেন।
এখন যদি এই পাঁচ প্রকল্প ঝুলিয়ে রেখে, অন্য কোনো ভালো প্রকল্পের জন্যও বিশ্বব্যাংকের যায়, তাহলে নতুন ঋণ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্রশ্ন তুলতে পারে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের প্রাপ্তির ৫৫ দিনের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো পিইসি সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনগর্ঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে পারে না। কারণ উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যথাযথভাবে করে না এবং অসম্পূর্ণ ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশন পাঠায়। এ কারণে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হয়। এতে দেখা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ করতে তিন বছরও লেগে যায়।
একটি পরিপত্রে বলা হয়েছে, পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপি পুনগর্ঠনের প্রয়োজন হলে)Ñসভার কার্যবিবরণী প্রাপ্তির ২০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিককল্পনা কমিশনে পাঠানোর বাধ্যবাধবতা রয়েছে।
পিইসি সভার কার্যবিবরণী প্রাপ্তির ২০ কাযদিবসের মধ্যে পুনগর্ঠিত ডিপিপি মন্ত্রণালয়/বিভাগ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো না হলেÑবিলম্বের কারণ ব্যাখ্যাসহ পুনর্গঠিত ডিপিপি ৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখিত সময়ের মধ্যে পুনগর্ঠিত ডিপিপি পাঠানো না হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী নয় বলে বিবেচিত হবে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে, পরিকল্পনামন্ত্রী/ প্রতিমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে তা প্রক্রিয়াকরণ করা যাবে বলে পরিপত্রে বলা হয়েছে। এদিকে ইআরডির এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি থেকে অর্থছাড় পর্যন্ত দেড় বছর সময় লাগে। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে- স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। অভিজ্ঞতার কারণে বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্প দেড় বছরের মধ্যে অর্থছাড়ে নিয়ে নিয়ে যেতে পারে সংস্থাটি। যেখানে অন্যান্য সংস্থার আড়াই থেকে তিন বছরও লাগে ডিপিপি প্রক্রিয়াকরণে।
সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়ায়, অসম্পূর্ণ ডিপিপির ক্ষেত্রে ছাড় দিচ্ছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। এ কারণে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সময় লাগছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন