বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বোরো উৎপাদনে বিশেষ নজর

খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ ১৭০ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা ২৭ লাখ কৃষক পাচ্ছেন বিনামূল্যে বীজ ও সার পর্যাপ্ত সার ও ডিজেলের মজুত রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পন

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আউশ ও আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ার পরও চালের দাম কমেনি। আমনের ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির ঘোষণাসহ সরকারের নানা উদ্যোগেও চালের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং প্রতি সপ্তাহেই সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে। চালের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও। এ অবস্থায় বিশ্বমন্দার বিষয়টি গত কয়েক মাস ধরে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যসঙ্কট দেখা দিতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা খাদ্যসঙ্কট নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে। আলোচিত মন্দা মোকাবিলার আগাম সতর্কতা হিসেবে বোরো উৎপাদন বাড়াতে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোয় সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছেন। এ জন্য ১৭০ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। এর মধ্যে বোরোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২৭ লাখ কৃষক বিনামূল্যে পাবেন বীজ ও সার। তিনটি ক্যাটাগরিতে দেয়া হচ্ছে এই প্রণোদনা। হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৮২ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় ১৫ লাখ কৃষকের প্রত্যেককে দেয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে ২ কেজি ধানবীজ। উচ্চফলনশীল জাতের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৭৩ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় উপকারভোগী কৃষক ১২ লাখ। এতে একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন। এ ছাড়া কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের সুবিধার্থে একটি মাঠে একই সময়ে ধান লাগানো ও কাটার জন্য ১৫ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এর আওতায় ৬১টি জেলায় ১১০টি ব্লক বা প্রদর্শনী স্থাপিত হবে। প্রতিটি প্রদর্শনী হবে ৫০ একর জমিতে, খরচ হবে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন-সহায়তা খাত থেকে এ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে এসব প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রম চলমান। ইতোমধ্যে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ প্রণোদনা বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে।

কৃষিসচিব মো. সায়েদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, বোরো উৎপাদনে নির্দিষ্ট লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে বাড়ানো হয়েছে সার ও ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুদ। সেচ কাজে নিরবিচ্ছিন বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখতে নেয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। ডিজেল ও সার পাচার রোধে বিজিবিসহ সীমান্ত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। বোরো উৎপাদনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও সংস্থা একসঙ্গে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে কাজ করার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে মনিটরিং সেল খোলা হচ্ছে। মাঠ ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হচ্ছে। মাঠ তদারকির জন্য কর্মকর্তাদের তালিকা করার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।

দেশে এখন বোরো ধান আবাদের প্রস্তুতি চলছে। এ জন্য প্রয়োজন সার, বীজ ধান ও সেচের। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে বোরো আবাদে সেচের জন্য বিদ্যুতের পিক পিরিয়ড। সরকার এ সময়ে প্রয়োজনে শহরে লোডশেডিং করে সেচের জন্য গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সরকার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫০ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের চাষ হবে ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান আবাদ হচ্ছে ৪০ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। স্থানীয় জাতের ধান চাষ হবে ২৫ হেক্টর জমিতে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে তিন কোটি ৫০ লাখ টন চাল ও ৫০-৬০ লাখ টন আটার চাহিদা রয়েছে। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মতো দেশে উৎপাদন হয়। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নিজে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে জোর তাগিদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ) গাজীপুরের ২৫তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস এবং প্রযুক্তি প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে শিল্পায়নে কৃষি জমি ব্যবহার না করতে বলেছেন। সেই সাথে কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে সে বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার নিজ নিজ এলাকায় খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য আরো উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বোরোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে এসব প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এবার উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের আবাদ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন করে ৫৩ হাজার হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হয়েছে। হাওড় অঞ্চলে আগাম বন্যার আশঙ্কা বিবেচনায় রেখে আগাম জাতের ধান উৎপাদনে জোর দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কৃষিবিষয়ক পরামর্শক কৃষিবিদ ডক্টর শহীদুল ইসলাম জানান, বৈশ্বিক মহামন্দার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা মোকাবেলায় কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার ও বীজ সরবরাহ করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা থাকতে হবে। বোরো উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশে দুর্ভিক্ষ হলেও বাংলাদেশে তা হবে না। সরকার কৃষকদের প্রণোদনা দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সময়মতো যথাযথ কৃষকদের কাছে পৌঁছলে বোরো উৎপাদনেও বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করা যায়।

এবার আমন ধানে লাভ পেয়ে শীত উপেক্ষা করে বোরো আবাদে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন কৃষক। ধানের এলাকা হিসেবে খ্যাত হাওড় অঞ্চলে চলছে বোরো আবাদের ধুম। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, মাগুরা, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় কৃষকরা শীত ও হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে বোরো ধান রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বোরো মৌসুমে দেশে ডিজেলচালিত ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুতে চলে এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে এক লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে। সরকার বিদ্যুৎচালিত পাম্পে ২০ শতাংশ করে ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রয়োজনে সেচকাজে ডিজেলেও ভর্তুকি দেয়ার সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন