০ সারাদেশে ৪৭ লাখ ৯৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ
০ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন চাল
০ কিছু এলাকায় পাহাড়ি ঢল ও বøাস্ট রোগে ক্ষতিগ্রস্ত
মিজানুর রহমান তোতা : এবার সারাদেশে বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ধানের থোড় স্টেজে যশোর ও খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় কমবেশী বøাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা এবং মাদারিপুরের শিবচরে ব্যাপক ক্ষতির কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না এমন আশঙ্কা মাঠ কর্মকর্তা ও কৃষকদের। নিকট অতীতে এবারের মতো বøাস্ট রোগের ব্যাপকতা দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে বøাস্ট রোগের ব্যাপকতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্রি-৬১ ও ব্রি-২৮ জাতের ধান বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিস উইং-এর পরিচালক চৈতন্য কুমার দাস প্রথমে কোথাও ধানের কোন ক্ষতি হয়নি দাবি করলেও পরে স্বীকার করেন বøাস্ট রোগে ক্ষতি হয়েছে সামান্য। যা ১% হবে না। তিনি বলেন, দেশের বেশকিছু এলাকায় এবার বøাস্ট রোগ দেখা যায়, তবে বেশীরভাগ স্থানেই ধানের পাতা বøাস্টে আক্রান্ত হয়েছে। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শের সাথে মোটেও একমত নন বলেও জানান। তার কথা, পাহাড়ি ঢল ও বøাস্টের কারণে সামগ্রিক উৎপাদনে তেমন একটা প্রভাব ফেলবে না বলে আশা করছি। তাছাড়া ৯৫ শতাংশ জমিতেই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবার পথে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কয়েজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নামপ্রকাশ করতে নিষেধ করে বলেন, এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য নেয়ার জন্য একাধিকবার মোবাইল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এদিকে, দেশের বিভিন্নস্থানে জাতীয় কৃষক সমিতি স্মারকলিপি দিয়ে বোরো জমিতে বøাস্ট রোগের (ভাইরাস) সংক্রামণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা দাবি জানিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহা পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে সারাদেশে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৮ লাখ হেক্টর জমি। আবাদ হয় ৪৭ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন চাল। সময়মতো রোগ-বালাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেয়া, মাঠ কর্মকর্তারা মাঠে নেমে পরামর্শ না দেয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় মার খেতে খেতে কৃষকের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে ধান উৎপাদনে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে। কৃষকের স্বার্থের দিকে খেয়াল না রেখে গত দু’টি মৌসুমে উৎপাদনের ভরা মৌসুমে ভারত থেকে ঢালাওভাবে চাল আমদানী করা হয়। এর জেরে বোরো, আমন ও আউশ আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তারা বলেছেন, বোরো আবাদ উৎপাদনে খরচ বেশী হওয়ার কারণে গম, ভুট্টা, তেলসহ রবি ফসল আবাদের দিকে দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে বেশী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন উপ পরিচালক জানান, চলতি মৌসুমে ওভারঅল বোরো ধান ভালো হয়েছে। তবে নানা কারণে কৃষকের খরচ বেশী হয়েছে। ইতোমধ্যে কোন কোন এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর ১৫/২০দিনের মধ্যে বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কৃষক ধরে ধান তুলতে পারবে। বিশেষ দরকার উপযুক্ত ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করা। নতুন ধান বাজারে উঠার পর কৃষকরা আরেক ধাক্কা খায়। কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকের বক্তব্য বিভিন্ন সময় বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলা হলেও বাস্তবে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বরাবরই অনুপস্থিত থাকে। কৃষকের কথা, দিনরাত পরিশ্রম করে কৃষকের পেট ঠেকে পিঠে আর বাজার ব্যবস্থপনার দুর্বলতায় ফড়িয়া, পাইকার, মজুদদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা পেট মোটা হয়।
এছাড়া, কৃষকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সুদখোর, দাদন ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, আড়তদার ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সাধারণত ধান উঠা মৌসুমে সাধারণ কৃষকদের ফাঁদে ফেলে নানা অজুহাতে কম দামে ধান কিনে ঠকানোর ফন্দি আঁটে। এসব দেখার দায়িত্ব যাদের তারা কখনোই দেখে না বলে অভিযোগ। যশোরের ডিহি ইউনিয়নের কৃষক মোঃ আলমসহ বেশ কয়েকজন কৃষক জানালেন, জমিচাষ, বীজ, চারা লাগানো, পরিচর্যা, সার, কীটনাশক, সেচ, ধান কাটা ও মাড়াইসহ প্রতি বিঘায় উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে কৃষকের। গতবারের চেয়ে চেয়ে সেচ খরচ পড়েছে বেশী। কৃষকদের বক্তব্য, আগে ১০বিঘা জমিতে সেচ দিতে গভীর সেচযন্ত্র ৮ঘন্টা চালালেই হতো। এখন এর ডাবল সময় লাগছে। তাও পানি উঠছে চুইয়ে। তার উপর বিদ্যুৎ সমস্যাও রয়েছে। সেজন্য সেচ খরচ প্রায় দ্বিগুণ গুনতে হয়েছে কোন কোন এলাকায়। শুধু সেচ নয় অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে। ইউরিয়া সারও বস্তাপ্রতি অতিরিক্ত মূল্যে ক্রয় করতে হয় কৃষকদের। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেন, প্রতিটি ইউনিয়নে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের ডিলার আছেন ২জন। প্রতিমাসে বেশীরভাগ ডিলার বরাদ্দপত্র নিয়ে কাগজপত্রে উত্তোলন দেখিয়ে বিক্রি করে দেন। সরকার নির্ধারিত রেট প্রতিবস্তা উরিয়া ৭শ’৪৫টাকা। কৃষককে ক্রয় করতে হয় ৮শ’ ২০টাকা। ব্যাপক চাহিদার সময়ে আরো বেড়ে যায়। ডিলাররা উপজেলা কৃষি অফিসার ও প্রত্যয়ন কর্মকর্তাকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করেন বলে অভিযোগ। যেমন, যশোর সদর উপজেলায় ২৬জন ডিলার রয়েছেন। নিয়মিত উত্তোলন করেন মাত্র ৯জন। বাকিরা বিক্রি করে প্রতিমাসে মোটা টাকা পকেটে তোলেন। এর মধ্যে পৌরসভাও একজন ডিলার আছেন। ইউনিয়নে যে পরিমাণ বরাদ্দ তারও বরাদ্দ একই। অথচ পৌরসভায় জমির পরিমাণ খুবই কম। একইভাবে প্রায় উপজেলাতেই কমবেশী এই কারবার হয়। অথচ জেলায় জেলায় উপ-পরিচালক, রিজিয়নে রয়েছেন অতিরিক্ত পরিচালক। তারা কেউই এই বিষয়টি তদারকি করেন না। সরকারী সুবিধা আছে কিন্তু কৃষক পাচ্ছেন না। দেশের নির্দিষ্ট জমিতে কর্মবীর কৃষকরাই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন। অথচ নানাভাবে তারা অবহেলিত, প্রতারিত, ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। কৃষির উন্নয়নে ও কৃষকদের সুবিধা অসুবিধা দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, তারা যথেষ্টা যতœবান নন বলেও অভিযোগ। তাই তাদের কৃষকের সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট মহল। তা না হলে শুধু ধান নয়, সব ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বিঘিœত হবে। এতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কৃষি ও কৃষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন