মৃত্যুর প্রায় পাঁচদিন পর বাংলাদেশি যুবক শাহিনুর রহমান শাহিনের লাশ হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ)। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে যশোরের শার্শার বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে লাশটি ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিবি ও বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা যায়। লাশের শরীরে অনেক জখমের চিহ্ন থাকায় তাকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের। তবে বিএসএফ-এর দাবি আটকাবস্থায় অসুস্থ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের সময় বিজিবি, ইমিগ্রেশন পুলিশ ও নিহতের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
বেনাপোল চেকপোস্ট আইসিবি বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, দুই দেশের প্রশাসন ও হাইকমিশনের হস্তক্ষেপে লাশ ফেরত দিয়েছে বিএসএফ। লাশটি পোর্ট থানা পুলিশ গ্রহণ করেছে।
সুস্থ দেখার তিন দিনের মাথায় মৃত্যুর খবর : নিহতের পরিবার জানায়, গত ১১ ডিসেম্বর পরিবারের সাথে অভিমান করে কোনো পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশের পুটখালী সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন মো. শাহিন। ওইদিনই ঘোনারমাঠ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা তাকে আটক করে মারধোর করে। পরে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে বনগাঁও থানায় সোপর্দ করা হয়।
তার আটকের খবর পেয়ে শাহিনুর রহমানের বড় ভাই পরদিন ১২ ডিসেম্বর ভারতে যান এবং কারাগারে শাহিনের সাথে দেখা করে আসেন। তখন শাহিন পুরোপুরি সুস্থ ছিল বলে তিনি দাবি করেন। ১৩ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন শাহিনের বড় ভাই। এর তিনদিন পর ১৬ ডিসেম্বর ভারতে তাদের আত্মীয়দের থেকে খবর পান যে, শাহিন মারা গিয়েছেন। ভারতীয় পুলিশ, ভারতে থাকা আত্মীয়দের টেলিফোনে এ খবর পাঠিয়েছিল বলে তারা জানান।
নিহতের খালাতো ভাই আজাদ হোসেন জানান, ‘প্রথমে তো আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি সে মারা গেছে। আমাদের বড় ভাই দেখে আসলো একদম সুস্থ। খানাখাদ্য, কাপড়-চোপড় দিয়ে আসলো। পরে তারা আমাদেরকে হোয়াটসআপে ছবি পাঠালে বিশ্বাস হয়েছে’।
এরপর নিহতের স্বজনরা লাশ দেশে ফেরাতে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে আবেদন করলে বৃহস্পতিবার লাশ হস্তান্তর সম্পন্ন হয়।
শরীরের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আঘাত নেই : ভারতীয় পুলিশ নিহতের পরিবারকে জানিয়েছে যে, আটক থাকা অবস্থায় শাহীন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন, পরে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলে স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। তবে শাহীনের লাশে প্রচুর জখমের চিহ্ন থাকায় পরিবারের দাবি তাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে।
জনাব হোসেন বলেন, ‘শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আঘাত নেই। এতো বাজে অবস্থা হয়েছে। যারা লাশের গোসল করিয়েছে তারাও দেখেছে কতো আঘাত। তার মধ্যে পোস্ট মর্টেমের কাটার দাগ তো আছেই’ -বলেন তার পরিবার।
বৃহস্পতিবার রাত একটায় শাহিনুর রহমানকে দাফন করা হয়। তিনি স্ত্রী ও পাঁচ বছরের একজন সন্তান রেখে গেছেন।
নিহতের মা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমার ছেলেকে তারা জেল দিতো। কেন এতো শাস্তি দিয়ে তারে মারল? আমার তো বুক খালি হয়ে গেল। এখন আমি চলবো কী করে। আমি নাতিরে, বউরে কী খাওয়াবো’?
ভারতের পুলিশ তার পোস্ট মোর্টম সম্পন্ন করলেও সেই রিপোর্টে কী বলা হয়েছে সে বিষয়ে পুলিশ বা বিজিবির পক্ষ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নির্যাতনের অভিযোগ তুললেও এ নিয়ে কোনো বিচার চাননি নিহতের পরিবার।
জনাব হোসেন জানান, ‘আমার ভাই তো চলেই গেছে। তার সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমাদের চাওয়ার কিছু নাই। আমরা বিচার চাই না। আমাদের ভাইয়ের লাশ পেয়েছি এটাই বেশি। আমাদের বিচার করবেডা কিডা’?
বিএসএফ-কে প্রতিবাদলিপি : তবে বিএসএফের পক্ষ থেকে বিজিবিকে জানানো হয়েছে যে, ১০ ডিসেম্বর শাহীনুর রহমানকে বৈধ কাগজপত্র না থাকার অপরাধে আটক করে এবং বনগাঁও পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ঘোনারমাঠ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ।
জেলে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ১৬ ডিসেম্বর সকালে শাহিনকে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ১৭ ডিসেম্বর সকালে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বলে বিএসএফ দাবি করছে।
২১ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর রহমান জানিয়েছেন, ‘পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের যুবক বিজিবির কাছে ধরা পড়েছেন- বিএসএফ এর পক্ষ থেকে এমন কোনো খবর তাৎক্ষণিকভাবে বিজিবিকে জানানো হয়নি’।
বিএসএফ কেন বিজিবিকে এ তথ্য জানায়নি এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রতিবাদলিপি দেয়ার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে দুই পাশে দুটা বাহিনী আছে। অথচ বাংলাদেশের নাগরিককে সেখানে আটক করা হল, তিনি অসুস্থ হলেন, তাকে জেলে পাঠানো হল এমনকি তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, অথচ আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। কিন্তু বিএসএফ আমাদের বলছে, তারা তাদের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে’।
কঠোর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায়.. : কিন্তু শাহীনুর রহমানের শরীরের এতো জখমের দাগ কিভাবে এল, সে কোথায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে বিএসএফ-এর কাছে, পুলিশের কাছে নাকি নাকি জেলে, এর কোনো ব্যাখ্যা বিএসএফ এর পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে বিবিসি বাংলা বারবার বিএসএফের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। নিহতের শরীরের ওই জখমের বিষয়ে পুলিশ বা বিজিবিও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি।
বিএসএফ কোন বাংলাদেশি নাগরিককে সীমান্তে হত্যা, গোলাগুলি বা নির্যাতন করলে বিজিবির পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠক ডেকে প্রথমে প্রতিবাদ, প্রতিবাদের চিঠি পাঠানো এবং কেউ ধরা পড়লে বা মারা গেলে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হয়।
বারবার সীমান্তে এমন হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এ ব্যাপারে কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। সীমান্তে এমন হত্যা নির্যাতন ঠেকাতে সরকারের সুনজর কামনা করেছেন বেনাপোলের পুটখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল গাফফার সরদার।
তিনি বলেন, ‘এভাবে বিএসএফ বারবার অন্যায় করে আমাদের লোক মেরে ফেলবে, এটা তো সরকারের খেয়াল রাখতে হয়। আমাদের দিকে ইন্ডিয়ার লোক আসলে তো আমরা আটকে রেখে খবর দেই। তারা নিয়ে যায়। তার পাসপোর্ট নাই, তাকে জেলে চালান দিক, এরপর জামিনে বেরিয়ে আসুক। আর এরা মেরেই ফেলতেছে, এ কেমন কথা’? সূত্র : বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন