রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কৃষি যন্ত্রপাতির দেশীয় উদ্ভাবন ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা এখনো বহুলাংশে কৃষি নির্ভর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে একদিকে কৃষিজমি কমছে, অন্যদিকে ক্রমহ্রাসমান স্বল্প জমির উপর ভিত্তি করে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই দ্বিবিধ বৈপরীত্য সামনে রেখে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে আমাদের কৃষকরা গত ৫০ বছরে অনন্য সাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নেপথ্যে আমাদের কৃষকদের শ্রমনিষ্ঠা, সৃজনশীলতা এবং দেশের কৃষি গবেষকদের উদ্ভাবনী প্রতিভার পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণ একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। এক সময় হালের বলদ এবং কৃষি শ্রমিকদের কায়িক শ্রমই ছিল আমাদের কৃষি উৎপাদনের মূল শক্তি। এখন দেশের ৯০ শতাংশ জমি চাষ করতে ছোট-বড় ট্রাক্টর ও পাওয়ারটিলার ব্যবহৃত হয়। সেই সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষিখাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফসল কাটার মওসুমে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট ও মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ধানচাষ অলাভজনক হয়ে উঠেছিল। আধুনিক হার্ভেস্টিং মেশিন ও রিপারের ব্যবহার সেই সঙ্কট ও খরচ কাটিয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। একইভাবে বীজ বপনে বেড প্লান্টার, জাপানি প্রযুক্তির সুইং মেশিন, বিভিন্ন সুবিধাযুক্ত ধান মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, খরচ ও সময় সাশ্রয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।
আমাদের কৃষকরা হাজার বছরের ধারাবাহিক কৃষি ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতায় হৃদ্ধ। দেশের কৃষিবিদ ও কৃষি গবেষকরা নতুন নতুন উচ্চ ফলণশীল কৃষিবীজ উদ্ভাবন করে কৃষকদের হাতে তুলে দিয়ে ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পুরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এখন চলছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যুগ। সেচপাম্প, ডিজেল, সার, বালাইনাশক, পাওয়ারটিলার, স্প্রেয়ার, হার্ভেস্টারসহ কৃষিতে ব্যবহৃত বেশিরভাগ পণ্য ও যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কৃষিতে সরকারের বিশেষ প্রণোদনায় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তত্ত্বাবধানে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আমদানির পেছনে সরকারের শত শত কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি যান্ত্রিকীকরণ ও অটোমেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হলে দেশের প্রত্যেক কৃষকের জন্য এসব কৃষিযন্ত্র সুলভ ও সহজলভ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের কৃষকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে দেশীয় উদ্ভাবক ও বিনিয়োগকারীদের কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও সরবরাহ নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ৫ লাখ টাকার জাপানি সুইং মেশিন দেশীয়ভাবে প্রস্তুত করা হলে তার মূল্য দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। খাদ্য, মৎস্য ও সবজি উৎপাদনে স্বয়ম্বরতার পাশাপাশি সার, সেচপাম্প, পাওয়ারটিলারসহ সব ধরনের কৃষিযন্ত্র উৎপাদনে স্বয়ম্বরতা অর্জন করাও অসম্ভব নয়।

মূল্যস্ফীতির কারণে কৃষি উৎপাদনে খরচ বাড়ার সাথে সাথে নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি দেশের দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এক গবেষনায় দেখা গেছে, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ প্রায় ৬০ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। উৎপাদন বৃদ্ধি ও অপচয় কমিয়ে আনার কারণে উৎপাদন ব্যয়ও কমে আসবে। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টিং মেশিনের মত আধুনিক যন্ত্র ছাড়া প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে ফসল কেটে ঘরে তোলা অসম্ভব। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা বড় বড় কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে বড় কৃষি খামারের জন্য যথোপযুক্ত হলেও আমাদের ক্ষুদ্র চাষিদের সামর্থ্য ও দেশীয় বাস্তবতার নিরিখে স্বল্পমূল্যে কৃষিযন্ত্র সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সামগ্রিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে ঘাটতি দূর করতে হলে কৃষিযন্ত্র ও কৃষিপণ্যের আমদানি পরনির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। একইভাবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভরা মওসুমে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করার নজির বন্ধ করতে হবে। কৃষিপ্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পচনশীল কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। কৃষিযন্ত্রপাতি আমদানি ও ব্যবহারে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশীয় উদ্যোগে কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন, বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার বিশেষ উদ্যোগ ও প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত নিরাপত্তা ও জ্বালানি সাশ্রয়ী কৃষি প্রযুক্তি এখন সময়ের দাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন