শিশুহত্যার বর্বরতা যেন থামছেই না। একের পর বর্বর হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। একেটটি হত্যাকা-ের পর মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখো মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন, পুলিশ ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অতিসক্রিয়তা প্রদর্শন করলেও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। গত বছর সিলেটে ১১ বছরের শিশু রাজন, খুলনায় রাকিব হত্যার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হলে জনমতের চাপে অভিযুক্তদের দ্রুতবিচারের আওতায় আনা হয়। এমনকি, সউদী আরবে পালিয়ে যাওয়া একজন আসামিকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং আদালত দোষীদের মৃত্যুদ-ে দ-িত করে। শিশুহত্যার বিরুদ্ধে এ ধরনের দ্রুত চরম শাস্তির দৃষ্টান্ত অপরাধীদের নিবৃত্ত করবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। তারপরও একের পর এক শিশুহত্যার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও মনোবিকলন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত দেড়মাসেই দেশে ৪০ জনের বেশী শিশু নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। অন্য একটি পত্রিকায় প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত ৫ বছরে ১১২২ জন শিশু সহিংসতা ও নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। গতমাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ১১ বছরের শিশু স্কুলছাত্র আব্দুল্লাহ পারিবারিক শত্রুতার জেরে হত্যাকা-ের শিকার হয়। প্রতিবেশীর পানির টাংকি থেকে আব্দুল্লাহর লাশ উদ্ধার করার কয়েক দিনের মাথায় হত্যাকা-ের মূল আসামি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার খবর বেরিয়েছে। এবার একটি বা দু’টি নয়, চারটি নিষ্পাপ শিশু একই সাথে নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের শিকার হল। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশু ৫ দিন আগে নিখোঁজ হওয়ার পর গত মঙ্গলবার পরিবারগুলো তাদের গলিত প্রায় মাটিচাপা লাশ খুঁজে পেয়েছে।
এ বর্বরতা-নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা নজিরবিহীন। এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। এই সমাজে এই রাষ্ট্রে কি হচ্ছে এসব! অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে শিশুহত্যার ভয়াল পাপাচার এর শেষ কোথায় তাও আমাদের জানা নেই। আমাদের সমাজদেহে যেন বিষাক্ত গ্যাংঘ্রিনের পচন ধরেছে। একশ্রেণীর মানুষ রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দুর্বৃত্তায়িত করেছে, দেশের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে এদের প্রভাব ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরা প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা পরিপুষ্ট। এদের বিচার করার, আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর যেন কেউ নেই। গত বছর অক্টোবর মাসে একজন সংসদ সদস্যের পিস্তলের গুলিতে ৮ বছরের একটি শিশু আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ঘটনার কিছুদিন পর সেই সংসদ সদস্যের সহাস্য বদনের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এখনো তার কোন শাস্তি হয়নি। একইভাবে গত ৫ বছরে যে সহশ্রাধিক শিশু নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে, তার কয়টির বিচার হয়েছে, হত্যাকারীরা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। বিচারহীনতার ধারাবাহিক সংস্কৃতিই শিশু ও দুর্বল মানুষদের চরম নিরাপত্তাহীনতার শিকারে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা মানবিক হলে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আরো দায়িত্বশীল, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সামাজিক ও পেশাগত দায়বদ্ধতার দ্বারা পরিচালিত হলে এ ধরনের নির্মম ঘটনা বেড়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। শিশুদের, নারীদের, সমাজের অসহায়-দুর্বল মানুষদের পাশবিক হিংস্রতা থেকে নিরাপদ করার স্থায়ী ব্যবস্থা করা না গেলে ইতিহাস এবং প্রকৃতির বিচার থেকে কেউ রেহাই পাবে না।
সামাজিক অপরাধ এবং হত্যাকা-ের মত ঘটনা সবদেশে সব সমাজেই ছিল এবং আছে। কিন্তু কোন সমাজে অপরাধীরা যখন সহজেই পার পেয়ে যায়, পেশাদার-সংঘবদ্ধ অপরাধীদের অপরাধমূলক ঘটনাও যখন রাজনৈতিক ব্লেইম গেমে পরিণত হয় এবং প্রকৃত অপরাধীদের ধরার বদলে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটে তখন অপরাধীরাই উৎসাহিত হয়। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যও নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরাও তথাকথিত বিভাগীয় লঘু শাস্তিকে তোয়াক্কা করছে না। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের ঘটনায় র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকটাই প্রমাণিত। এর আগে নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকি নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিল। মামলার তদন্তে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসার পরও তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। এভাবেই শিশুহত্যার সাথে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে। হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের যে সব পরিবার তাদের সন্তানদের হারিয়েছে, তারা প্রথমেই পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিল। পুলিশ যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে হয়তো শিশুরা বেঁচে যেত। পারিবারিক-সামাজিক নিরাপত্তা এবং বেড়ে ওঠার সব রকমের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সব সমাজে শিশুরাই হচ্ছে সবচেয়ে অগ্রাধিকারভোগী শ্রেণী। শিশুরা রাজনীতি বোঝে না, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সামাজিক কোন্দলের কার্যকারণ বোঝে না। অথচ এখন শিশুরাই এসব সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং দুর্বৃত্তায়নের বড় টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। শিশু অপহরণের মত ঘৃণ্য ঘটনাগুলোতে পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্বহীন আচরণ অমার্জনীয়। প্রতিটি শিশুহত্যার ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে পেশাগত অসততার দায়ে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে একটি সমাজের সামাজিক-রাজনৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য উপযুক্ত সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন