রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভরাডুবি হয়েছে। ৯ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এ্যাডঃ হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। তিনি শুধু জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে পরাজিত হয়েছেন তা নয়, বরং একজন জুনিয়র (আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী) রাজনীতিতে যার কোন অবস্থান ছিল না তার কাছেও ধরাশায়ী হয়েছেন। আর ২য় অবস্থানে থাকা ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী নির্বাচনে যার তেমন কোন প্রচার-প্রচারণাও ছিল না তার অর্ধেকের কম ভোট পেয়েছেন। অথচ বিগত কয়েক বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে শুধু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনই নয়, সংসদ নির্বাচনেও এখানে জাতীয় পার্টির পরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকে আওয়ামীলীগের ভোট। অথচ এবারে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪র্থ অবস্থানে গেল আওয়ামীলীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রার্থীর এমন শোচনীয় পরাজয় আওয়ামীলীগের সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা মেনে নিতে পারছেন না। এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর এই শোচনীয় ভরাডুবির বিষয়টি নিয়ে। অফিস-আদালত, দোকান-পাট, পাড়া-মহলা সর্বত্রই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে আওয়ামীলীগৈর ভরাডুবির বিষয়টি। বিশেষ করে ডালিয়ার ৪র্থ স্থানে যাওয়ার বিষয়টি সবখানেই সরব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তার এই লজ্জাজনক ভরাডুবির পেছনে বিভিন্ন জন বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করলেও কমবেশি সকলেই যোগ্য প্রার্থী বাছাই, কর্মীদের সাথে সম্পৃক্ততা ও সমন্বয়নহীনতা এবং নেতাকর্র্র্মীদের অসহযোগিতাকেই দায়ী করছেন। এহেন লজ্জাজনক ভরাডুবির কারন হিসেবে আওয়ালীগের একাধিক নেতাকর্মী ও নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে মুলতঃ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারন সবার মুখে উঠে এসেছে।
নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার চার লাখ ২৬ হাজার ৪৭০। এর মধ্যে একজন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন। মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) ২২৯টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়ল পান ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার লতিফুর রহমান মিলন পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এ্যাডঃ হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া পেয়েছেন ২২ হাজার ৩০৬ ভোট। এছাড়া বাংলাদেশ কংগ্রেসের আবু রায়হান ১০ হাজার ৫৪৯, জাকের পার্টির খোরশেদ আলম পাঁচ হাজার ৮০৯, খেলাফত মজলিসের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল দুই হাজার ৮৬৪, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) শফিয়ার রহমান পাঁচ হাজার ১৫৬ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মেহেদী হাসান বনি দুই হাজার ৬৭৯ ভোট পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ভরাডুবির কারণ হিসেবে যোগ্য প্রার্থী বাছাই না করাকেই মুল কারন হিসেবে দায়ী করছেন সকলেই। তাছাড়া, সঠিক পরিকল্পনা, দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবসহ নির্বাচনী খরচ মেটাতে কারপন্যতাকেও প্রাধান্য দিচ্ছেন খোদ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, এবারের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের এই প্রার্থীর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা তো দুরের কথা দলীয় নেতাকর্মীদেরই অনেকেই তাকে চিনেন না। তার সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা একেবারেই কম ছিল। হুট করে মনোনয়ন দাখিলের আগেরদিন তার নাম উঠে আসল। আগে থেকে কোন কিছুই জানলাম না, মনোনয়ন দাখিলের দিন তার নাম শুনলাম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, দলীয়ভাবে কঠোর নির্দেশনা না থাকায় নেতাকর্মীরা মেয়র প্রার্থীর পক্ষে তেমন কাজ করেননি। যে দু-একজন করেছেন তারা দায়সারা গোছের কাজ করেছেন। তাছাড়া ভোটে কাজ করা কর্মীদের তেমন টাকা-পয়সা না দেয়ায় তৃণমুলের কর্মীরা অধিকাংশই এলাকা ভিত্তিক কাউন্সিলরদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরাই বেশি জয়লাভ করেছেন।
নগরীর জাহাজ কোম্পানী বাটার গলি এলাকার ব্যবসায়ী ও স্থায়ী বাসিন্দা বিশ্বাস ষ্টোরের মালিক বাবু জানান, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যোগ্য প্রার্থী দেয়নি। যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জানাশোনা তেমন একটা নেই। অনেক কর্মীরাই তাকে চেনে না। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য একজন শক্ত প্রার্থী দেয়া দরকার ছিল। দিলে এমন ভরাডুবি হত না। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর বিগত দু’টি নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালেই তো হিসেব পাওয়া যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতা ইনকিলাবকে জানান, আগে থেকে কোন সাড়া-শব্দ নেই, হঠাৎ মনোনয়ন দাখিলের আগের দিন তাকে চূড়ান্ত করা হয়। যে কারনে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সময় স্বল্পতার কারনে সব ভোটারের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দলীয় সেরকম কঠোর নির্দেশনা না থাকায় দলের নেতাকর্মীরাও আমাদের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেনি। যে কারনে এমন ভরাডুবি হয়েছে।
এদিকে, নিজ দলের প্রার্থীর এমন ভরাডুবির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অপর একজন নেতা বলেছেন, আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে না, করলেও ভোট দেয় না। বরং বিপক্ষেই অবস্থান নেয়। এবারের সিটি নির্বাচনই শুধু নয়, সদ্য সমাপ্ত জেলা পরিষদ নির্বাচনও তার স্বাক্ষ্য বহন করে। জেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলের প্রার্থী একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। তাছাড়া, আওয়ামীলীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠন মিলে যতগুলো কমিটি ও কমিটির নেতাকর্মী আছেন তারা এবং তাদের পরিবারের ১/২টি করে ভোট পড়লেও এর চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেত নৌকার প্রার্থী। কিন্তু তাদেরই ভোট না পড়ার কারনে এমন লজ্জাজনক ভরাডুবি ঘটল সিটি নির্বাচনে। ## হালিম আনছারী, রংপুর। ২৯-১২-২২
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন