সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মাদরাসার সিলেবাস এবং কিছু কথা

অধ্যক্ষ মো. ইয়াছিন মজুমদার | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

২০২৩ সালের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক ইতোমধ্যে মাদরাসাগুলোতে পৌঁছেছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর মোট বইয়ের সংখ্যা ১৫টি, তম্মধ্যে মাত্র ৪টি বই ইসলামী ও আরবি বিষয়ের, বাকি ১১টি বই সাধারণ শিক্ষার। সাধারণ শিক্ষার বইগুলো হলো: ১) জীবন জীবিকা, ২) স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ৩) বিজ্ঞান অনুশীলন, ৪) বিজ্ঞান অনুসন্ধান, ৫) ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন, ৬) ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধান, ৭) গণিত, ৮) ইংরেজি, ৯) ডিজিটাল প্রযুক্তি, ১০) চারুপাঠ এবং ১১) শিল্প সংস্কৃতি। আরবী ৪টি বিষয় হলো: ১) আকাঈদ ফিকহ, ২) কোরআন মজিদ, ৩) কাওয়াঈদুল লোগাতুল আরাবিয়া ও ৪) লুগাতুল আরাবিয়া এত্তেছালিয়া।

শুনা যাচ্ছে মাদরাসার কেন্দ্রীয় (পাবলিক) পরীক্ষায় মাত্র আরবী ১০০ নম্বরের ১টি বিষয়ের পরীক্ষা হবে। তাছাড়া আরবী অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে না, শিক্ষকরা মূল্যায়ন নম্বর দেবে, বাকি সাধারণ বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে।

পাঠ্য বইসমূহের বিভিন্ন গল্প, কবিতা, মূর্তির ছবি নিয়ে ওলামা-মাশায়েখ ও পীর সাহেবগণ প্রতিবাদ করছেন, তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমি তাই সে বিষয়ে লিখবো না। মাদরাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও অতীতে এ শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে কিছু লিখবো। আমি আমার গ্রামের পাশের মন্তলী রহমানিয়া ফাজিল মাদরাসায় পড়ালেখা করেছি। একই মাঠের এক পাশে মাদরাসাটি এবং অপর পাশে ছিল মন্তলী স্কুল এন্ড কলেজ। বর্তমানে স্কুলটি সামান্য সরিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাঠ আলাদা করা হয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের কোনটিতে ছাত্র সংখ্যা কম নেই। যদি প্রশ্ন করা হয়, পাশাপাশি স্কুল-মাদরাসা হওয়ার পরও মানুষ তার সন্তানকে মাদরাসায় কেন ভর্তি করাচ্ছে? উত্তর আসবে, ভালো আলেম হওয়ার জন্য। আলেম বানানোর ইচ্ছা না থাকলে অবশ্যই স্কুলে ভর্তি করাতো। দুনিয়াবি চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে যতটুকু না হলে নয় এর বেশি সাধারণ শিক্ষার বোঝা মাদরাসায় না চাপিয়ে ভালো আলেম হওয়ার উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন আবশ্যক। সাত অন্ধ হাতি দেখতে গিয়ে যে অঙ্গ যিনি ধরেছেন তিনি হাতিকে সেরূপই মনে করেছেন এবং হাতির আকৃতি নিয়ে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছেন। কারণ, সে নিজে ধরে অনুভব করেছে, তাই অন্য জনের কথা মানতে সে রাজি নয়। যদি তাদের চোখ থাকতো, সম্পূর্ণ হাতি দেখতো, তবে ঝগড়া হতো না, ঠিক তেমনি ভালো আলেম না হলে ইসলামের আংশিক জ্ঞান লাভ করে যিনি যতটুকু বুঝবেন ততটুকুকে চূড়ান্ত মনে করে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবেন, যা ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়, একই সাথে চিকিৎসকের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা শিক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তাকে কেউ প্রশ্ন করে না, তুমি চিকিৎসা বিদ্যা জান, প্রকৌশল বিদ্যা জান না কেন? সেভাবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভালো আলেম হওয়ার শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, তাদের সাধারণ শিক্ষায় পারদর্শী করতে সিলেবাসের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে কেন?

মোগল আমলে বা তারও আগে আলেমদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্টপোষকতা করা হতো। আলেমরা শিক্ষা বিস্তারে কাজ করতো, তাদের বেতন মন্ত্রীর সমান ছিল। ইংরেজ আসার আগে এলাকার ভূমি লাখেরাজ ও ওয়াকফ হিসেবে সরকার মাদরাসার হাতে দিতো, যা থেকে মাদরাসার ব্যয় যেমন নির্বাহ হতো, তেমনি জনগণের চাহিদার আলোকে এলাকার উন্নয়ন কাজে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ অর্থ বরাদ্দ দিত। তখন শুধু বাংলায় আশি হাজার মাদরাসা ছিল। ইংরেজরা আলেম ও মুসলমানদের এ মর্যাদা দেখে এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসে এ সকল সম্পত্তি মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ থেকে নিয়ে নেয়, ফলে অর্থাভাবে মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বছর পর মুসলিম নেতৃবৃন্দ চিন্তা করেন, মাদরাসা ও আলেম না থাকলে এক সময় ইসলাম ও মুসলিম বলতে কিছু থাকবে না। তাই তারা ইংরেজ সরকারের নিকট কলিকাতা আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে আলোচনা করেন। ইংরেজ সরকার সেখানে ইংরেজ বিরোধী কিছু হয় কিনা এ আশংকায় অধ্যক্ষ হবে ইংরেজ, এ শর্তে দাবি মেনে নেয়। সরকারি রোষানলে পড়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিন্তা করে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইংরেজ সরকারের শর্ত মেনে নেয়। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়নি। নেতৃবৃন্দ নিজেদের অর্থে ১৭৮০ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে। তবে সিলেবাস ও পাঠ্য সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না। এ দায়িত্ব যিনি পালন করতেন তার পদবী ছিল হেড মাওলানা। কলিকাতা আলীয়ার প্রথম হেড মাওলানা মোল্লা মজদুদ্দীন। আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর সেখান থেকে অসংখ্য যোগ্য আলেম তৈরি হয়, যাতে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়। এর প্রায় একশত বছর পর ১৮৬৬ সালে ইংরেজ আমলে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে পরিচালনার জন্য স্থাপিত হয় কাওমী মাদরাসার মুল ভিত্তি দেওবন্দ মাদরাসা। তখন আলীয়া এবং কাওমী মাদরাসার সিলেবাস একই রকম ছিল। কোরআন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি ভালো আলেম হওয়ার মতো সিলেবাস ছিল, সাধারণ বিষয় ছিল না। আলীয়া থেকে পাশ করে কেউ কাওমী মাদরাসায় শিক্ষকতা করতো। কাওমী মাদরাসা থেকে পাশ করে কেউ আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করতো। ১৯৮০ সালে সরকার জনবল কাঠামো ও শিক্ষাগত সনদ নির্ধারণ করে দিলে কাওমী সনদ দিয়ে আলীয়ায় চাকরির সুযোগ শেষ হয়।

এবার আবার পিছনের আরেকটি দিক তুলে ধরি। ১৯১৫ সালে আলীয়াতে সাধারণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নিউস্কিম এবং সাধারণ বিষয় ছাড়া ওল্ডস্কিম, এ দু’ ধারায় বিভক্ত করা হয়। শর্ষিনা আলীয়া, সিলেট আলীয়া, ঢাকা আলীয়ার একাংশ নিউস্কিম সিলেবাস গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। তারা ওল্ডস্কিমে থেকে যায়। এক পর্যায়ে ১৯৫৭ সালে সরকারি এক ঘোষণায় সকল নিউস্কিম মাদরাসা স্কুল-কলেজে পরিণত হয়। লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা তার বিশাল সম্পত্তি মাদরাসার নামেই ওয়াকফ করে। কিন্তু তা এখন নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে মোহসিনিয়া মাদরাসা এখন মোহসিন কলেজে পরিণত হয়েছে। এভাবে তিনটি ছাড়া সকল মাদরাসা কলেজে পরিণত হয়েছে। এভাবে মিশরেও নানা যুক্তি ও প্রলোভনে মাদরাসায় সাধারণ বিষয় পাঠ্যভুক্ত করতে করতে ইসলামী শিক্ষা বিলুপ্ত করা হয়েছে। আজকের আলীয়া মাদরাসার সিলেবাস দেখে মনে হচ্ছে, এগুলোও সে পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ, আগে স্কুলে ১০০ নম্বরের আরবী ১০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা পরীক্ষা দিতে হতো। আরব অনেক দেশে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছাত্রকেও তার বিষয় ভিত্তিক পরীক্ষার সাথে সাথে কোরআন-হাদিসের একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের পরীক্ষা দিতে হয়। বর্তমানে মাদরাসায় যে সিলেবাস ৯০% মুসলমানের দেশে এ সিলেবাস স্কুল-কলেজের জন্য প্রয়োজন।

মাদরাসায় গত কিছুদিন আগে ও বাংলা ইংরেজি ১০০ নম্বর করে ছিল। ১০০ নম্বর পড়েই তারা ২০০ নম্বর পড়ুয়া স্কুল কলেজ ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতো। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় শর্তারোপ করে ২০০ নম্বর করে বাংলা, ইংরেজি না থাকলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না। ফলে ২০০ নম্বর করে ৪০০ নম্বরের বাংলা, ইংরেজি দিতে গিয়ে মাদরাসার মূল আরবী বিষয় সংকুচিত করা হয়। মাদরাসা ছাত্রদের পূর্বের ন্যায় ১০০ নম্বর করে বাংলা-ইংরেজি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রাখা হোক। মাদরাসার সিলেবাসে সাধারণ বিষয়ের বোঝা কমিয়ে যোগ্য আলেম তৈরির পথ সুগম করা হোক। মাদরাসার সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্ব শুধুমাত্র মাদরাসা শিক্ষিতদের হাতে দেয়া হোক। সে সাথে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাদরাসা সিলেবাস থেকেও প্রশ্ন রাখার ব্যবস্থা রাখা হোক।

লেখক: অধ্যক্ষ ফুলগাঁও ফাযিল ডিগ্রি মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
hassan ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২, ৫:০১ পিএম says : 0
Our beloved country is ruled by enemy of Allah and also enemy of our sacred as scuh they use all their force to eliminate Islam from our country. Madrasa children will be corrupted like secular education. We need to liberate country from the clutch of the ruler.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন