ঢাকায় মেট্টোরেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাইলফলক রচিত হয়েছে। এক জটিল আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় মেট্টোরেল প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তা ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রশ্নে দৃঢ় মনোভাবের ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটেছে। ঢাকার আয়তন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অনুপাতে রাস্তার পরিমান অনেক কম। এ কারণেই সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ সত্ত্বেও যানজট বেড়েই চলেছে। ঢাকায় গণপরিবহনের গড় গতিবেগ মানুষের পায়ে হাঁটার গতির সমান। ঢাকায় প্রত্যেক কর্মজীবী মানুষকে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে যানজটের কারণে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা সময় অপচয় করতে হয়। এই অপচয়ের আর্থিক, মানসিক ও পরিবেশগত ক্ষতি বিপুল। আর্থিক মানদন্ডে তা লক্ষকোটি টাকার বেশি। গত এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বিশ্বের মেগাসিটিগুলোর মধ্যে বসবাসের অযোগ্য তালিকার প্রথমদিকে স্থান পাচ্ছে ঢাকা। রাজধানী শহরকে চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য রেখে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। রাজধানী শহরের বিরূপ অবস্থা দেশের বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে প্রথমেই যানজটে স্থবিরতার চিত্র বদলানো জরুরি। ঢাকার বাস্তবতায় গতানুগতিক রাস্তায় তা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মেট্টোরেল ও এলিভেটেড রেলওয়েই একমাত্র বিকল্প। প্রধানমন্ত্রীর ঐকিান্তিক প্রয়াসে তা এখন বাস্তব রূপ লাভ করতে চলেছে। এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
এক সময় বলা হতো উন্নয়ন রেললাইন ধরে আসে। বৃটিশ আমলে যোগাযোগ ও গণপরিবহণে রেললাইন ও লোকোমোটিভই ছিল অন্যতম ব্যবস্থা। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সময়ের বিবর্তনের হাত ধরে এখন গণপরিবহনে বহুমাত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। সে ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুমাত্রিক উন্নয়ন মডেলের রূপরেখা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারে শামিল হচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা ও গভীর পদ্মানদীর উপর বহুমুখী সেতু নির্মাণ, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও সৈকত শহর কক্সবাজারের সাথে সংযোগ সৃষ্টিকারী কর্ণফুলী টানেল এবং এবং রাজধানীর যানজট নিরসন ও নগর যোগাযোগের সর্বাধুনিক মডেল হিসেবে মেট্টোরেলের আংশিক সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের মহাসরণীতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। পরিকল্পনামাফিক ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটির সবগুলো লাইন বাস্তবায়িত হলে ঢাকার নগরচিত্র আমূল বদলে যাবে বলে আশা করা যায়। চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড যাতে থেমে না যায় বা স্তিমিত হয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে দেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার দায় সবচেয়ে বেশি। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শীতা ও দৃঢ়তা আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলেও রাজনৈতিক-সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন টেকসই হতে পারেনা। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে যে সব অভিযোগ উঠেছে তা অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। এটি হঠাৎ করে শুধুমাত্র বর্তমান সরকারের সময়েই শুরু হয়নি। তবে অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মত প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে এবং দৃঢ় ও সাহসী সিদ্ধান্তে দেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আশাব্যঞ্জক উন্নয়নও সম্ভব হতে পারে। একদিকে অকাঠামো উন্নয়ন দৃশ্যমান হচ্ছে অন্যদিকে দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। মূদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতির উন্নয়নে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা দূর করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিবাচক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কোটি কোটি কর্মহীন, অভাবী-দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের বাস্তবসম্মত উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। ইতিমধ্যে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার গতিও কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ও উন্নয়ন সহযোগীদের মতামত পুরোপুরি উপেক্ষা করা যাবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রত্যাশা, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করা হলে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের এতদিনের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সারাদেশ থেকে রাজধানীমুখী কর্মহীন মানুষের ঢল বন্ধ করে জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের উপর ভরসা করলে অবকাঠামো খাতে এত উন্নয়ন সম্ভব হতো না। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং অবশিষ্ট সব উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এমন দূঢ় ভ’মিকাই প্রত্যাশা করছে মানুষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন