সুজলা সুফলা এই বাংলাদেশের উর্বর মাটি, প্রতুল জলাশয়, সহনশীল ষড়ঋতু যে কোনো খাদ্য উৎপাদনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। যেন সৃষ্টিকর্তার অশেষ এক উপহার এই বাংলাদেশ আর দেশের মাটি। কোন রকমে বীজ মাটিতে বুনতে বা মাটির সংস্পর্ষে আসতে পারলেই সবল ও পুষ্ট চারা হয়ে বৃক্ষরূপে জন্মাতে খুব বেশি সময় আর কষ্ট করারও প্রয়োজন হয় না। তাই তো শীতের সকালে ঘর থেকে বের হলেই দেখা যায় কত রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল। এসবের মধ্যে ভিটামিন ও মিনারেলস টইটুম্বুর থাকে। মূলত ভিটামিন ও মিনারেলস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আমাদের শরীরকে খাদ্যের শর্করা, আমিষ ও চর্বির ব্যবহারে সাহায্য করে। এছাড়া শীতকালে শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শুষ্কতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যও সতেজ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস খুবই জরুরি।
শীতে মৌসুমি শাকসবজি বা ফল গ্রহণের মাধ্যমে সহজেই শরীরের চাহিদা মোতাবেক পুষ্টি উপাদান, বিশেষ করে ভিটামিন ও মিনারেলসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতকালের শাকসবজি এবং ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণাগুণও বেশি হয়ে থাকে। এ সময় বাজারে দেখা যায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, লালশাক, পালংশাক, মুলা, শালগম, শিম, টমেটো, পেঁয়াজ পাতা, লাউ, ব্রোকলি, মটরশুঁটি, গাজর, ধনিয়াপাতা, লাউ ইত্যাদি। এসবে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফলিক এসিড, এন্টিঅক্সিডেন্ট, আঁশ ও ভিটামিন বিদ্যমান। অস্থিক্ষয় রোধে ও শরীরে রক্তকণিকা বা প্লাটিলেট গঠনেও শীতকালীন শাকসবজির ভূমিকা অপরিসীম। ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-ই এর ঘাটতি পূরণ করে এসব ফল ও শাকসবজি। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন-ই; যা মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে রক্ষা করে ও চুলপড়া কমায়।
ফুলকপি ও বাঁধাকপি : ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রায় সবারই পছন্দের। ফুলকপিতে রয়েছে ভিটমিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড ও পানি। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার রয়েছে। ফুলকপিতে এমন কিছু উপাদান আছে, যা কিডনির পাথর ও ক্যান্সার নিরাময়ে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। ফুলকপিতে কোনো চর্বির মাত্রা নেই। ফুলকপি তাই কোলেস্টরোলমুক্ত, যা কিনা শরীরের বৃদ্ধি ও বর্ধনে বিশেষ উপযোগী। পাশাপাশি বাঁধাকপিতে রয়েছে ভিটামিন-সি ও ফাইবার। শরীরের হাড় শক্ত ও মজবুত রাখতে এবং ওজন কমাতে বাঁধাকপির জুড়ি নেই। তাছাড়া বাঁধাকপি আলসার প্রতিরোধে ভালো কাজ করে।
ব্রোকলি : ব্রোকলিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। ব্রোকলি অত্যন্ত উপাদেয়, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি সবজি। এটি চোখের নানাবিধ রোগ, রাতকানা, অস্থি বিকৃতি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে।
গাজর : গাজর অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও খাদ্যআঁশ সমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি, যা প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। তরকারি বা সালাদ হিসেবে এই সবজি খাওয়া হয়। গাজরে আছে বিটা ক্যারোটিন যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। অন্যান্য উপাদানগুলো অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। গাজরে উপস্থিত ক্যারোটিনয়েড ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। ত্বকের খসখসে ও রোদে পোড়া ভাব দূর করে।
জলপাই : শীতে প্রচুর জলপাই ওঠে বাজারে। এতে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’, ‘ই’, লৌহ ও অসম্পৃক্ত চর্বি। ফলে এটি স্থূলতা কমায়, শরীরে উপকারী চর্বি বাড়ায়। বাতের ব্যথা, হাঁপানি উপশমে জলপাই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এছাড়া টক জাতীয় এ ফলে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন-ই। এ ভিটামিনগুলো দেহের রোগজীবাণু ধ্বংস করে, উচ্চরক্তচাপ কমায়, রক্তে চর্বি জমে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস করে হৃৎপিন্ডের রক্ত প্রবাহ ভাল রাখে। এতে হৃৎপিন্ড থেকে বেশি পরিশোধিত রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছায়, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে। জলপাইয়ের খোসায় রয়েছে আঁশ জাতীয় উপাদান। এ আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়, কোলনের পাকস্থলির ক্যানসার দূর করতে ভূমিকা রাখে।
ধনিয়াপাতা : ধনিয়াপাতা এখন সারা বছর পাওয়া গেলেও মূলত এটি শীতকালীন সবজি। ধনিয়াপাতা সরাসরি সালাদ হিসেবে এবং রান্না করে দুভাবেই খাওয়া যায়। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-কে ও ফলিক এসিড রয়েছে, যা আমাদের ত্বকের জন্য যথেষ্ট প্রয়োজনীয়। ধনিয়াপাতার ভিটামিনগুলো আমাদের ত্বকে প্রতিদিনের পুষ্টি জোগায়, চুলের ক্ষয়রোধ করে, হাড়ের ভঙ্গুরতা দূর করে এবং মুখের ভেতরের নরম অংশগুলোকে রক্ষা করে।
টমেটো : ক্যালরিতে ভরপুর টমেটোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, যা মানবদেহের হাড় ও দাঁত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ভিটামিন-সি এর অভাবজনিত স্কার্ভি ও চর্মরোগ প্রতিরোধে টমেটো বেশ কার্যকরী। এতে বিদ্যমান অন্য এক উপাদান হল লাইকোপেন, যা ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। টমেটোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট, যা কিনা প্রকৃতির আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির বিরু০দ্ধ কাজ করে থাকে।
মটরশুঁটি : শীতকালীন সবজি মটরশুঁটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি; প্রতি ১০০ গ্রামে পাওয়া যায় ১২৫ কিলোক্যালরি। এটি উদ্ভিজ আমিষের একটি বড় উৎস।
শিম : শিমে আমিষ ছাড়াও স্নেহ ও ফাইবার থাকে। শিমের আঁশ খাবার পরিপাকে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকাংশে দূর করে। রক্তে কোলেস্টরোলের মাত্রা কমায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে পাকস্থলী ও প্লিহার শক্তি বাড়ায়। লিউকোরিয়াসহ মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে, শিশুদের অপুষ্টি দূর করে।
পালং শাক : পালং শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, আয়রন ও ফলিক এসিড, যা আমাদের দেহের জন্য জরুরি। পালংশাক আমাদের শরীরে আর্থাইটিস, অস্টিওপোরোসিস ছাড়াও হৃদরোগ ও কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
মূলা : শীতের আরেকটি পরিচিত সবজি হলো মুলা। বিভিন্ন ক্যান্সার, কিডনি ও পিত্তথলিতে পাথর তৈরি প্রতিরোধে সাহায্য করে মুলা। এর মধ্যে থাকা বিটা-ক্যারোটিন হৃদরোগের ঝুঁকি দূর করে। শরীরের ওজন হ্রাস করে আলসার ও বদহজম দূর করতে সাহায্য করে।
লাউ : লাউয়ে প্রচুর জল থাকে, যা দেহের জলের পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ডায়রিয়াজনিত জলশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। লাউ খেলে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকে। প্রস্রাবের সংক্রমণজনিত সমস্যা দূর হয়। কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। উচ্চ রক্তচাপবিশিষ্ট রোগীদের জন্য এটি আদর্শ সবজি। নিদ্রাহীনতা দূর করে এবং ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস, যা দেহের ঘামজনিত লবণের ঘাটতি দূর করে। দাঁত ও হাড়কে মজবুত করে। চুলের গোড়া শক্ত করে এবং চুল পেকে যাওয়ার হার কমায়। লাউ কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ, পেট ফাঁপা প্রতিরোধ করে।
শীতকালীন মৌসুমী ফল : শীত মৌসুমে বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন জাতের কুল বা বরই, কমলালেবু, আমলকি, আপেল, সফেদা, ডালিম ইত্যাদি পাওয়া যায়। এসব ফলে আছে ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘এ’, মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ‘ই’, এন্টিঅক্সিজেন, ফাইবার। এসব মৌসুমি ফল কেবল মুখরোচকই নয়, এতে থাকা নানা ভিটামিন এবং মিনারেলস দাঁত, মাড়ি মজবুত করতে যেমন সাহায্য করে তেমনি নানা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এসব ফল ও শাকসবজি সুস্থতার পাশাপাশি সজীবতা, সৌন্দর্য ও তারুণ্য ধরে রাখে। শরীরে আঁশের ঘাটতি মেটাতে ও ভিটামিন ‘সি’র জোগান দিতে শীতের সময় বেশি করে টকজাতীয় ফল খেলে ভালো।
পানি ও তরল জাতীয় খাবার : এছাড়া প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি, তরল জাতীয় খাবার, স্যুপ, গরম ডাল, মিক্সড ফলের জুস এ ধরনের খাবারগুলো গ্রহণ করলে শরীরের ভেতরে আরাম অনুভব হবে ও বাহ্যিকভাবে সুন্দর ও আকর্ষণীয় লাগবে।
এই শীতকালীন সময়ের সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে সকলে সুস্থ ও সুন্দর থাকুন, উপভোগ করুন তাজা সবজি ও ফলমূল। আনন্দ থাকুক অন্তর জুড়ে।
নাজিয়া আফরিন
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা, মানবিক সাহায্য সংস্থা
সিনিয়র পুষ্টিবিদ (এক্স), কিংসটন হাসপাতাল
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন